নুসায়ের ইয়াসিন: এক মিনিটে বিশ্বজয় করা এক অনলাইন যুবক !



 টিম প্রতিবেদন :

২৪ বছরের একটি ছেলে প্রতিদিন একটি করে ভিডিও বানালেন টানা তিন বছর। ঝড়-বৃষ্টি, রোগ-শোক সবকিছু ছাপিয়ে, একদিনও ছুটি না নিয়ে, প্রতিদিন মানে প্রতিদিন বানাতে থাকলেন একটি করে এক মিনিটের ভিডিও। দিনে শুটিং, রাতে এডিটিং, পরদিন সকাল সেই ভিডিও আপলোড করতে থাকলেন ফেসবুকে। ৩ বছরে ৬৪ টি দেশ ঘুরে ঘুরে বানালেন এইসব ভিডিও। এই অসম্ভবকে সম্ভব করা ছেলেটি কে ? কেন তিনি এই কাজ শুরু করলেন ? আর কিভাবে সম্ভব করলেন এমন অতিমানবীয় এই কাজটিকে ?
অসম্ভবকে সম্ভব করা এই ছেলেটির নাম নুসায়ের ইয়াসিন। ফেসবুকে যারা ভিডিও দেখেন তাদের কাছে জনপ্রিয় মুখ ফিলিস্তিনী ইসরাইলী এই যুবকসবাই চেনেন নাস ডেইলীর নাস নামে। ফেসবুকে তার ফলোয়ারের সংখ্যা এখন ১ কোটি ৩০ লাখ। আর এখন পর্যন্ত ভিডিও আপলোড করেছে ১১৮৬টি। যার প্রথম ১০০০ টি ভিডিওর দৈঘ্য ছিল মাত্র এক মিনিট । ভিডিও দেবার জন্য তিনি ইউটিউব নয় বেছে নিয়েছেন ফেসবুককে। কারন তার কাছে মনে হয়েছে ফেসবুকে দ্রুত মানুষের কাছে পৌছানো যায় ।আর মানুষ খুবই ব্যস্ত ।এক মিনিটের বেশি হলে হয়ত সবাই দেখবেনা । আর ১ মিনিটেই তিনি জয় করে নিয়েছেন কোটি মানুষের মন ।

২০১৪ সালে হাবার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনোমিক্স এ গ্রাজুয়েশন শেষ করেন নাস। একই বছর পেপালের মোবাইল পেমন্টে কোম্পানী ভেনমোতে যোগ দেন তিনি। বেতন ছিল বছরে এক কোটি ২ লাখ টাকা । মানে মাসে সাড়ে ৮ লাখ টাকা । কিন্তু বেতন যতই ভালো হোক না কেন নয়টা পাঁচটার এই গদবাঁধা চাকরি তার একটুও ভালো লাগছিল না।
তাই সিদ্ধান্তটা পাকাপাকি তিনি নিয়েই নিলেন ২০১৬ সালে ।

 অফিসে গিয়ে জমা দিয়ে দিলেন পদত্যাগপত্র। দেড় বছর ধরে জমানো ৬০ হাজার ডলার , একটি ক্যামেরা ও একটি প্লেনের টিকিট কিনে সোজা চলে গেলেন এয়ারপোর্টে। এর মধ্যে নিজের জীবনের আসল লক্ষ্য স্থির করে ফেললেন নাস, আর সেটি হলো তিনি হবেন একজন বিশ্বভ্রমণকারী।

নিজের এই বিশ্ব ভ্রমনের অভিজ্ঞতা জানানোর জন্য তিনি একটি ফেসবুক পেজ খুললেন, নাম দিলেন নাস ডেইলিএরপর টানা ১০০০ দিন ৬৪ টি দেশ ঘুরে ঘুরে বানালের ১০০০ টি ভিডিও। ২০১৬ তে শুরু করে এ বছরের ৫ জানুয়ারিতে শেষ হয় তার ১০০০ তম দিন। এর পর বাকিটা ইতিহাস । ফেসবুকে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ এখন এই নুসায়ের ইয়াসিন নাস ।

কি থাকতো তার ভিডিওতে ?

তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিওগুলি একটি হচ্ছে how this guy cleaned a lake যা ১৩ কোটি বারের বেশি দেখা হয়েছে ফেসবুকে । এছাড়া planate warriors দেখা হয়েছে ৮ কোটি বার। almost perfect country,1 doller microscope এবং segregation তার জনপ্রিয় ভিডিওর গুলির মধ্যে অন্যতম।

ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দের মধ্যেই বড় হয়েছেন নাস তার নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সেগরিগেশন ভিডিওটিতে তিনি দেখিয়েছেন মানুষে মানুষে বিভেদ কিভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন । সাথে দেখিয়েছেন বর্ন ধর্ম নির্বিশেষে একসাথে বসবাস করার উদাহরনও আছে এই পৃথিবীতে ।

এছাড়া টুরিস্টদের কাছে সবচেয়ে কম জনপ্রিয় দেশগুলোকে তিনি বেছে নিয়েছেন তার ঘোরার জন্য । যেমন যাত্রা শুরু করেছেন কেনিয়া দিয়ে । এছাড়া রুয়ান্ড, তানজানিয়া, ইকুয়েডরের মত দেশ তার ঘোরার তালিকায় ছিল প্রথমে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয় তিনি দেখিয়েছেন মানুষ কিভাবে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে ।

ইসরাইলের উত্তরের কৃষি প্রধান শহর আরাবাতে জন্ম নিয়েছেন নাস। ১৯৪৮ সালের পর ফিলিস্তিনের এই অংশটুকু এখন ইসরাইলিদের দখলে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা । তিন ভাই বোন মিলে তাদের সংসার । নাস মুসলিম পরিবারের জন্ম নেন ১৯৯২ সালে । তার মা একজন শিক্ষিকা বাবা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ।

নাস সবসময় একটি টি শার্ট পরেন, যার বুকে তার বয়স লেখা থাকে ।তবে তা শতকরা হিসেবে। কারন নাস মনে করে জীবন খুব ছোটব এবং তার এক সেকেন্ডও নস্ট করতে রাজি নন তিনি।এই টি শার্ট সবসময় তাকে স্মরন করিয়ে দেয় জীবনের আর কতটুকু বাকি । নাস ৭০/৭২ বছরের বেশি বাঁচবেন না বলে ধারণা করেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে নাস এসব করার টাকা পায় কোথায় ?

নাসের ইনকামের মুল অংশ আসে ফেসবুকের বিজ্ঞাপন থেকে।বর্তমানে তার সম্পদের পরিমান এখন ২.৫ লক্ষ ডলার বা সোয়া দুই কোটি টাকা, যা তার মতো অন্যান্য ট্রাভেল ভ্লগারদের তুলনায় বেশ কম।

একটি ভিডিওতে নাস জানিয়েছেন এক মাসেই তিনি ইনকাম করেছেন ৭০ লক্ষ টাকা। যার বেশির ভাগ এসেছে ফেসবুকের দেয়া এসব বিজ্ঞাপন থেকে।

এছাড়া নাসের নিজের একটি কোম্পানীও আছে।নাস ডেইলীর টিশার্ট বিক্রি করেন। অনলাইনেই তাদের শো রুম। চাইলে আপনিও অর্ডার করতে পারেন। একেকটি টি শার্টের দাম পড়বে ২০০০ টাকার মতো । আর ইকোনোমিক্স ডিগ্রি থাকায় ব্যবসার কনসালটেন্সিও ভালো করতে পারেন নাস। এছাড়া কেউ চাইলে তার কোম্পানীর জন্য মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট বানিয়ে দেয় নাস ও তার টিম । আর এ বছরের শুরুর দিকে ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের সাথে দেখা করার পর নাস ডেইলি এখন শো স্ট্যাটাসে উন্নীত হয়।

একহাজার দিনের চ্যালেঞ্জ শেষ করে নাস এখন শুরু করেছেন সপ্তাহের চ্যালেঞ্জ। এখন প্রতি সপ্তাহে একটি করে ভিডিও বানান নাস। ১০০ সপ্তাহ চলবে তার এই চ্যালেঞ্জ।

কিন্তু কিভাবে শুটিং করেন নাস ?

নাস তার ছোট এসএলআর ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করে ভিডিওগুলো। এছাড়া তার একটি ভিডিও ড্রোনও রয়েছে। প্রতিটি ভিডিও করতে সময় নেয় গড়ে ৬ ঘণ্টা এবং সেগুলো এডিট করতে সময় নেয় গড়ে ৩ ঘণ্টা। ছোট একটি টিম কাজ করে নাস ডেইলি জন্য। যেখানে আছেন একজন পোলিশ সঙ্গীতজ্ঞ ও ভিডিও ব্লগার অ্যাগন হেয়ার এবং নাসের মার্কিন বান্ধবী অ্যালাইন টামির।

এখন যারা তার মতো হুট করে চাকরি ছেড়ে দেশ ঘোরার প্লান করছেন কিংবা ভিডিও বানিয়ে টাকা কামাতে চাচ্ছেন তাদের জন্য নাসের উপদেশ হলো Im not here to tell you to take risks and quit your job and travel the world. No, dont do that if it doesnt make you feel comfortable and excited.

নাসআরবি শব্দের অর্থ হল জনগণফলে নুসায়ের ইয়াসিন যে নাস ডেইলি পেজের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের জীবনের সুন্দর দিকেই তুলে ধরতে চাচ্ছেন তা সহজে অনুমান করা যায় । নামের অর্থের মতোই নাস কাজ করছে জনগনের জন্য । আর এই জনগন শুধু বিশেষ একটি দেশের জনগন নয়, এই জনগন সামানা বিহীন এক বিরাট অনলাইন বিশ্বের জনগন ।

 টিম প্রতিবেদন