লাইলী-মজনু জুটির জন্ম পারস্যে |
শিল্পিত পারু ।।
আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় পৃথিবীর
শ্রেষ্ঠ পাঁচটি প্রেমিক জুটির নাম বলুন তো। আপনিও নিশ্চয়ই বলবেন লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ,
রাধা-কৃষ্ণ, দেবদাস-পার্বতী কিংবা রোমিও-জুলিয়েট। কিন্তু আপনি কি জানেন এই চরিত্রগুলোর প্রেমের শেষ পরিনতি
কি হয়েছিল? কিংবা এদের মধ্যে কে আদর্শ
প্রেমের প্রতিনিধিত্ব করে ? চলুন প্রেমিক জুটিগুলোর গল্পে নজর দেই ।
৫. দেবদাস-পার্বতী
দেবদাস পার্বতী। একসময় প্রেমে ব্যর্থ পুরুষদের
প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিল দেবদাস। মুখ ভর্তি দাড়ি দেখলেই সাবই তাকে ডাকতো দেবদাস বলে। এখন সেই
পরিস্থিতি কিছু পাল্টেছে । তবে ২০০২ সালে শাহরুখ খানের ‘দেবদাস’ সিনেমা দেখে বর্তমান প্রজন্ম কিছুটা ধারনা পেয়েছে এই দুই কালজয়ী প্রেমিক জুটির।
বাংলা সাহিত্যের এই দুই চরিত্রের স্রস্টা
হচ্ছেন শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়। ১৯০০ সালের এই নামেই উপন্যাস লিখলেও
এটি প্রকাশ পায় ১৯১৭ সালে । শরৎচন্দ্র এটি মাতাল অবস্থায় লিখেছিলেন বলে জানা যায়। আর তাছাড়া সে সময়ের সমাজ এমন প্রেমের গল্প মেনে
নিবে কিনা তা নিয়ে বেশ সংশয়ে ছিলেন লেখক।
তাই ১৭ বছর সাহস করেননি এই উপন্যাস প্রকাশ করার। তবে প্রকাশের পর ‘দেবদাস’এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে
ব্যর্থ প্রেমিকে আরেক প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল দেবদাস।
কিন্তু কি ছিল এর কাহিনী?
দেবদাস আর পার্বতী একই গ্রামের ছেলে-মেয়ে । ছোটবেলা থেকে একজন আরেকজনকে পছন্দ করে । দেবদাস বড়লোক পার্বতী গরীব। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের সম্পর্ক পরিবার মেনে নেয় না পার্বতীর বিয়ে হয়ে যায় ধনী বয়স্ক এক জমিদারের সাথে।
দেবদাস আর পার্বতী একই গ্রামের ছেলে-মেয়ে । ছোটবেলা থেকে একজন আরেকজনকে পছন্দ করে । দেবদাস বড়লোক পার্বতী গরীব। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের সম্পর্ক পরিবার মেনে নেয় না পার্বতীর বিয়ে হয়ে যায় ধনী বয়স্ক এক জমিদারের সাথে।
দেবদাস সারাজীবন ভুলতে পারেনি তার প্রথম প্রেমকে। পার্বতীরও মনেও দেবদাস বেঁচে ছিল দীর্ঘদিন । শেষ
পর্যন্ত পার্বতির বাড়ির সামনে গিয়েই তার মৃত্যু হয় দেবদাসের। এরপর ইতিহাস। বাঙ্গালির হৃদয়ে গত ১০০ বছর ধরে
টিকে আছে এই প্রেমের এই অসফল জুটি।
৪. লাইলি মজনু
লাইলী মজনু। এরা দুজন ইরানের
চরিত্র। এদের সৃষ্টা ইরানী কবি জামি, নিজামী, আমির খসরুসহ অনেকে। কারন জামি প্রথম এই দুজনের গল্প বললেও
জনপ্রিয় হয় পরবর্তী কবিদের কাছে এসে। আর এই গল্পের বাংলায় ভাবানুবাদ করেন দৌলত উজির বাহরাম
খান। সেটার
রচনাকাল ১৫৬০-১৬৬৯ এর মধ্য হবে, যদিও এ নিয়ে ভিন্নমত আছে।
কাহিনী কি ছিল এই জুটির?
কাহিনী কি ছিল এই জুটির?
বিশাল ধনীর পুত্র কায়েস, লাইলীর
প্রেমে পড়ে দিওয়ানা বা মজনু হয়ে যায়। লাইলীরও তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশিত হয় প্রবলভাবে কিন্তু
বিবাহে আসে বাধা। লাইলীর বিয়ে হয় অন্যখানে। মজনু মরুভুমিতে
ঘুরে বেড়ায় লাইলীকে না পাবার বিরহে। লাইলি তার স্বামীর সাথে চলে যায় এবং শোকে কাতর হয়ে মারা যায়। মজনু ঘুরতে ঘুরতে লাইলীর
কবরের পাশে গিয়ে পৌঁছায় এবং কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই মারা যায়। তাদের দীর্ঘ
বিরহজীবন সমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। লাইলী–মজনু এমন গল্প নিয়েই টিকে আছে কয়েকশ বছর।
৩. শিরি ফরহাদ
শিরি ফরহাদ। এ দুজনের গল্প ইরানের কবি ফেরদৌসির ‘শাহানামা’ মহাকাব্যে আছে । কিন্তু এরা জনপ্রিয় হয় আরেক কবি নিজামীর
লেখার পর। সেটা ছিল রাজা খসরু- রাজকন্যা শিরিনের প্রেম। তাদের দুজনে প্রেমের মাঝখানে হঠাৎ ঢুকে যায়
ফরহাদ নামের একজন পাথর খোদাই করা শিল্পী।
শিরিকে দেখে পাগল হয় যায় ফরহাদ। শুরু হয় নতুন প্রেম। চিঠি লিখা লিখি। এ খবর রাজা খসরু জানার পর ফরহাদের কাছে মিথ্যে
প্রতিশ্রুতি দেয়, সে যদি একাই পাহাড় কেটে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত সিঁড়ি বানাতে পারে তাহলে
শিরির সাথে তার বিয়ে দেবে।
ফরহাদ প্রেমিকাকে পাবার আশায় দিনরাত পরিশ্রম করে পাহাড় কাটার কাজ শেষ করে। তখন খসরু মিথ্যা করে জানায় শিরিন মারা গেছে। ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুর খরব শুনে, দু:খে পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে আত্নহত্যা করে ফরহাদ।
ফরহাদ প্রেমিকাকে পাবার আশায় দিনরাত পরিশ্রম করে পাহাড় কাটার কাজ শেষ করে। তখন খসরু মিথ্যা করে জানায় শিরিন মারা গেছে। ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুর খরব শুনে, দু:খে পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে আত্নহত্যা করে ফরহাদ।
ফরহাদের গল্প এখানে শেষ হলেও
শিরির গল্প এখানে শেষ হয় না। খসরু আর শিরির প্রেমের গল্প আগাতে তাকে। তারা বিয়ের প্রস্তুতি নিলে ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা। ছেলের হাতে খুন হয় খসরু। শিরিনকে বিয়ে করতে চায় পুত্র আর তাতে সম্মতি না দেয়ায় এই খুন। এটা মেনে নিতে পারেনা শিরিন তাই বাধ্য হয়ে আত্নহত্যা করে।
খসরু-শিরিনকে এক কবরে সমাহিত করা হয়। এই
গল্প মুলত খসরু আর শিরির প্রেমের গল্প। তাদের প্রেম উপাখ্যানের মাঝখানে একপাক্ষিক
প্রেম নিয়ে আসে ফরহাদ এবং কষ্ট করে তাকে না পাওয়ায় আত্নহত্যা করে।
তাহলে এই প্রেম কেন শিরি –ফরহাদের প্রেমের গল্প আবহমান কাল ধরে মুসলমানের ঘরে চলে
আসছে তা গবেষণার বিষয়।
২. রাধা কৃষ্ণ
রাধা-কৃষ্ণ। সর্ম্পকে তারা দুজন মামী-ভাগনা হলেও এই দুটি
চরিত্র 'পবিত্র প্রেমের' প্রতীক হয়ে আছে। ভারতে জন্ম এই দুই চরিত্রের। হিন্দু ধর্মের মানুষদের কাছে তো তারা
দেবতার আসন লাভ করেছে। জানা যায় রাধার স্বামীর নাম ছিল অয়ন ঘোষ।
কৃষ্ণের তো অনেক প্রেমিকা ছিল। তবু রাধার জন্য কৃষ্ণের যে আকুতি, কিংবা কৃষ্ণ বিনে রাধার যে বিরহ তা দিয়ে হাজার হাজার গান আর কবিতা লিখা হয়েছে। তাদের আজীবন না পাওয়ায় বিরহে কেটেছে। বর্তমান প্রেমিক প্রেমিকাদের মধ্যে এই জুটি খুব জনপ্রিয় না হলেও ভাববাদী লেখক শিল্পী এবং হিন্দু ধর্মের কিছু মানুষের মধ্যে তাদের পবিত্র ভালোবাসা এক বিশেষ রুপ নিয়ে টিকে আছে।
কারো কারো কাছে রাধা রাধা-কৃষ্ণ স্রস্টার সাথে সৃস্টির মিলন বা প্রেমের প্রতীকরুপ। এরা বাস্তবের কোন চরিত্র নয়। তবে বাস্তব চরিত্রের এ গল্প তাতে দেখা যায় এই দুই জুটির শেষ মিলন হয় না। কৃষ্ণকে না পাওয়ার আজন্ম বিরহেই কাটে রাধার। তবে কৃষ্ণের বিরহের কথা খুব একটা শোনা যায় না।
কৃষ্ণের তো অনেক প্রেমিকা ছিল। তবু রাধার জন্য কৃষ্ণের যে আকুতি, কিংবা কৃষ্ণ বিনে রাধার যে বিরহ তা দিয়ে হাজার হাজার গান আর কবিতা লিখা হয়েছে। তাদের আজীবন না পাওয়ায় বিরহে কেটেছে। বর্তমান প্রেমিক প্রেমিকাদের মধ্যে এই জুটি খুব জনপ্রিয় না হলেও ভাববাদী লেখক শিল্পী এবং হিন্দু ধর্মের কিছু মানুষের মধ্যে তাদের পবিত্র ভালোবাসা এক বিশেষ রুপ নিয়ে টিকে আছে।
কারো কারো কাছে রাধা রাধা-কৃষ্ণ স্রস্টার সাথে সৃস্টির মিলন বা প্রেমের প্রতীকরুপ। এরা বাস্তবের কোন চরিত্র নয়। তবে বাস্তব চরিত্রের এ গল্প তাতে দেখা যায় এই দুই জুটির শেষ মিলন হয় না। কৃষ্ণকে না পাওয়ার আজন্ম বিরহেই কাটে রাধার। তবে কৃষ্ণের বিরহের কথা খুব একটা শোনা যায় না।
১. রোমিও জুলিয়েট
শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ট্রাজিডি ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’। সারা পৃথিবীর প্রেমিক –প্রেমিকারদের কাছে আদর্শ
জুটি। দুজন
দুজনকে এত ভালোবাসতো যে মৃত্যুও তাদের আলাদা করতে পারেনি। শেক্সপিয়ার এটি লিখেন ১৫৯৫ সালে। যদিও ইটালীতে এই গল্প আগেই
লিখেছিলেন অর্থর ব্রুক কিন্তু শেক্সপিয়ার নুতুন কিছু চরিত্র যুক্ত করে লিখার পর এই জুটি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ।
দুজন দুজনকে
ভালোবেসে বিয়ে করে রোমিও ও জুলিয়েট । কিন্তু তাদের পরিবার কোনভাবে মেনে নেয় না ।
পারিবারিক দ্বন্দ সংঘাতে রুপ নেয়ে। শেষে জুলিয়েটের আত্নহত্যার মিথ্যা খবর বিশ্বাস
করে প্রথমে রোমিও আত্নহত্যা করে। পরে রোমিওর মৃত্যু সইতে না পেরে জুলিয়েটও আত্নহত্যা করে। মৃত্যুতে শেষ হয় এই দুই বিখ্যাত
প্রেমিক জুটির অধ্যায় ।
উপসংহার :
উপসংহার :
পাঁচ জুটির মধ্যে দেখা যায় কারোই
শেষ পর্যন্ত সুখের মিলন হয়নি। আর গল্পের শেষে চারজন পুরুষই প্রেমিকার বিরহে মারা
গেছেন। দেবদাস, মজনু, ফরহাদ আর রোমিও। শুধু বিরহে মৃত্যু বরণ করেননি কৃষ্ণ। আর নারী মারা গেছেন ৩ জন। লাইলী, শিরি
এবং জুলিয়েট। এর মধ্যে শিরি মারা যান অন্য কারনে ফরহাদের বিরহে নয়। পার্বতী ও রাধা আজীবন বিরহে কাটায়।
রোমিও-জুলিয়েটই একমাত্র জুটি যারা প্রেমের পর বিয়ে করতে পেরেছিলেন এবং দুজনের মৃত্যু বরন করেন একসাথে একই কারনে। জুলিয়েট আত্নহত্যা করেন রোমিও আত্নহত্যা করার পর।
রোমিও-জুলিয়েটই একমাত্র জুটি যারা প্রেমের পর বিয়ে করতে পেরেছিলেন এবং দুজনের মৃত্যু বরন করেন একসাথে একই কারনে। জুলিয়েট আত্নহত্যা করেন রোমিও আত্নহত্যা করার পর।
এই চরিত্রগুলো সবই কাল্পনিক চরিত্র। গল্প কবিতায় এই চরিত্রগুলো নির্মাণ করেছেন কবি লেখকেরা। তবে চরিত্র নির্মাণে তারা কোন বাস্তব চরিত্র থেকে আনুপ্রানিত হতে পারেন। শিরি-ফরহাদের গল্পে জানা যায় পারস্যের রাজা খসরু ও রাজকন্যা শিরিনের প্রেম কাহিনীই লিখেছিলেন ফেরদৌসি। তবে রাধা-কৃষ্ণ নিয়ে দ্বিমত আছে। এই দুটি চরিত্র বাস্তব নাকি কাল্পনিক তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে !!
শুধু গল্পের দিকে তাকালে রোমিও-জুলিয়েট ছাড়া অন্য চরিত্রগুলো আদর্শ প্রেমের প্রতীক হয়ে ওঠার মতো নয়। কোন কোন প্রেম তো বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে অসামাজিকতার পর্যায়েও পড়ে। তবু কেন এই চরিত্রগুলো মানুষের কাছে এত আদর্শ
প্রেম আর পবিত্র ভালোবাসার প্রতীক হয়ে শতশত বছর ধরে টিকে আছে তা এক বিষ্ময় বটে !!
শিল্পিত পারু
কবি ও লেখক