সালমান শাহ’র মৃত্যু : এক অমীমাংসিত রহস্য !


শিল্পিত পারু
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ । মাত্র ২৪ বছর বয়সে হঠাৎ করে হারিয়ে যান বাংলা সিনেমার রাজপুত্র সালমান শাহ । কেউ বলে তিনি আত্নহত্যা করেছিলেন কারো মতে তাকে হত্যা করা হয়েছে । সালমান শাহ মৃত্যুর খবরে গোটা দেশ সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল । কেউই এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি ।এরপর একের পর এক তরুণ তরুনীর আত্নহত্যার খবর প্রকাশ পেতে থাকে । প্রিয় নায়কের মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে আত্নহত্যা করেছিল তার ২১ জন ভক্ত । শুধু বাংলা সিনেমা নয় বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে এমন ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে না । কিন্তু আজও এই মহানায়কের মৃত্যু রহস্যের সমাধান পাওয়া যায়নি । কিন্তু কেন ?

মুত্যুর পর প্রথম জানা যায় সালমান শাহ আত্নহত্যা করেছেন।ধারণা করা হয়, স্ত্রীর সামিরার সাথে অভিমান করে তিনি এই ঘটনা ঘটিয়েছেন । মৃত্যুর পরপরই তার বাবা কমর উদ্দীন আহমেদ রমনা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলাও দায়ের করেন ।
তবে মা নীলা চৌধূরীর দাবি পরিবারের আজান্তেই বাবার স্বাক্ষর নিয়ে পুলিশ নিজেরাই এই অপমৃত্যুর মামলাটি দায়ের করেছিলেন। এরপর ১৯৯৭ সালে ২৪ জুলাই বাবা কমরউদ্দীন এটিকে হত্যা মামলায় পরির্বতন করার আবেদন করেন। ২০০২ এ তিনি মারা যাবার পর মা নীল চৌধুরী একাই লড়ে যাচ্ছেন এই মামলা। তার দাবি তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আর স্ত্রী সামিরা এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত । গত ২৩ বছর ধরে তিনি একাই ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে আদালতে আদালতে ঘুরছেন ।
সরকারি তদন্ত সংস্থা থেকে চারবার চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে এই মামলার । থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডি, র‍্যাব এরপর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি তদন্ত চালায় ১২ বছর । সবার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয় সালমান শাহ আত্নহত্যা করেছেন । কিন্ত পরিবারের না রাজির কারনে এই মামলা ২০১৭ সালে পুনরায় তদন্তের জন্য দেয়া হয় পুলিশ বুর‍্যো অফ ইনভেস্টিগেশন বা পিবি্আইকে । সেই তদন্ত প্রতিবেদন এখনও জমা হয়নি ।
কিছুদিন আগে রুবি নামের একজন আমেরিকা থেকে ফেসবুকে জানায় সালমানকে হত্যা করা হয়েছে, আর তার প্রত্যক্ষ সাক্ষি তিনি নিজে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর বেশি দুর আগায়নি । অনেকের ধারণা করেন সামিয়ার বাবা ও ক্ষমতাবান গডফাদারদের কারনে মামলার সঠিক তদন্ত বারবার ব্যহত হচ্ছে ।
সালমানের আত্নহত্যার পক্ষে যে ধারণা গুলো করা হয় তা হল : স্ত্রী সামিরার সাথে তার সেদিন ঝগড়া হয়েছিল । স্ত্রী সাথে অন্য কোন পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে অথবা তার সাথে নায়িকা শাবনুরের সম্পর্ক নিয়ে এই জগড়া াহয়েছিল বলে ধারনা করা হয়। সেই মনোমালিন্যের জেরে তিনি আত্নহত্যা করে থাকতে পারেন ।
আর তাকে হত্যার পিছনে সাম্ভাব্য দুটি কারন ধরা করা : প্রথমটি হলো আজিজ মোহাম্মদ ভাই নামের একজন আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদারের সাথে সম্পর্ক ছিল স্ত্রী সামিরার আর সেটা মেনে নিতে পারেনি সালমান , স্ত্রীকে নিষেধ করেছিল তিনি শোনেননি । এর জেরে স্ত্রী আর গডফাদারের লোকজন তাকে হত্যা করে থাকতে পারে।
দ্বিতীয় কারনটি ধারনা করা হয়, সালমানের জনপ্রিয়তা এত বেশি তুঙ্গে ছিল যে সিনেমাপাড়ার কয়েকটি পক্ষে সালমানের চরম বিরোধী গ্রুপ হয়ে গিয়েছল । তার একক আধিপত্যকে তার কেউই মেনে নিতে পারছিলো না। তারাই সম্মিলিত ভাবে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করতে পারে । যদিও কোনটাএরই সঠিক কোন প্রমঅণ পাওয়া যায় না ।
সালমানের মৃত্যু হত্যা হোক কিংবা আত্নহত্যা তার একটা সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। চারটি সংস্থা যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানে সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। এই রহস্যগুলো উদ্ঘটন হওয়া প্রয়োজন । তার পরিবার এবং ভক্তকুল বারবার যে প্রশ্নগুলো উত্তর খুছছে তা কয়েকটি হলো :
১. কিসের অভিমান থেকে সালমান আত্নহত্যা করেছিল। স্ত্রীর কোন সঠিক জবানবন্দি পাওয়া যায় না কেন ? কেন তার মানসিক অবস্থা আত্নহত্যার দিকে মোড় নিল ? কি হয়েছিল সেইদিন ?
২. প্রতিবেশীরা আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিল সেতদিন ফ্লাটে তার ধস্তা ধস্তির শব্দ শুনেছিল । কিসের ধস্তাধস্তি ? তদন্তে এর কোন উত্তর নাই কেন ?
৩. আলামত সঠিকভাবে জব্দ করা হয়নি কেন ? যে ফ্যানে আত্নহত্যা করেছিল সেই ফ্যান্‌ও জব্দ করা হয়নি কেন ? তার ঘরে চেতনানাশক ঔষধ পাওয়া গিয়েছিল কেন ? মই কোথা থেকে এসেছিল সালমানের ঘরে ?
৪. সালমান যে ব্রান্ড এর সিগারেট খেতেন না সেই ব্যান্ডের সিগারেটের ঘরে এল কিভাবে ?
৫. সকালে বাবা সালমানের সাথে দেখা করতে এসেছিল, তাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি কেন ? কেন বলা হয়েছিল সালমান ঘুমাচ্ছে ?
৬. তার মৃত্যুর পর কাউকে খবর দেয়া হলো না কেন ? পরিচালক সোহানুর রহমান সবাইকে খবর দিতে হলো কেন ?
সরকারী সংস্থার তদন্ত বারবার বলছে সালমান আত্নহত্যা করেছে । কিন্তু কেন করেছে এই আত্নহত্যা, তার একটি যথাযোগ্য কারন স্পষ্ট না পাওযায়, পরিবার এই প্রতিবেদনগুলো মানতে রাজি হচ্ছে না । সাংবাদিকদেরও খুব একটা অনুসন্ধানী কাজ করতে দেখা যায় না সালমানের মৃত্যু নিয়ে । এভাবেই পার হতে চললো দুই যুগ । বাংলা সিনেমার একজন মহানায়কের মৃত্যুর রহস্য অমীমাংসিত থেকে যাবে নাকি একদিন সত্য উন্মোচিত হবে সেটাই দেখার বিষয় । বাংলা সিনেমার এই রাজপুত্রের প্রতি শ্রদ্ধা