The Plague of Athens (c. 1652–1654) by Michiel Sweerts, |
পারভেজ সেলিম ।।
পৃথিবীর ইতিহাসে বারবার দেখা দিয়েছে মহামারি। নতুন নতুন রোগের
প্রাদুর্ভাবে মারা গিয়েছে কোটি কোটি মানুষ। তারপর প্রতিষেধক তৈরি হবার পর সেই রোগ থেকে মুক্তি
মিলেছে ঠিকই কিন্তু নতুন আরেকটি রোগ এসে কাঁপিয়ে দিয়েছে মানবজাতির ভিত।
সবচেয়ে প্রাচীন যে মহামারির খোঁজ পাওয়া যায় সেটিও চীন। আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর
আগে। চীনের ‘হামিন মাঙ্গহা’ নামের প্রাচীণ স্থানে কয়কশ মৃতদেহ একসঙ্গে কবর দেয়ার সন্ধান
পায় প্রত্নতত্ত্ববিদেরা । তাদের মতে কোন একটি বিশেষ রোগে অসংখ্য মানুষ একসঙ্গে মারা
গিয়েছিল যা দ্রত সময়ে মাটির নিচে পুতে ফেলা হয়েছিল। এটাই এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত
সবচেয়ে পুরাতন মহামারির নিদর্শণ। পৃথিবীর কয়েকটি ভয়াবহ মহামারির দিকে নজর দেয়া যাক যা বদলে
দিয়েছে মানবজাতির ইতিহাস ।
৭. এইডস: পঞ্চাশের দশকে আফ্রিকায় বানর থেকে এই রোগটি মানব দেহে ছড়ায়। আফ্রিকার এক
দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে এটি ছড়িয় পড়ে সারা বিশ্বে। এখন পর্যন্ত ৩ কোটি ২০
লক্ষ মানুষ মারা গেছে এইডস। ১৯৮০ সালে প্রথম
রোগটি সনাক্ত করতে পারে চিকিৎকেরা। এক অচেনা রোগের
মহামারিতে ভুগতে থাকে বিশ্ব ।
৬. কলেরা : ১৮২০ সাল। থাইল্যান্ডে
প্রথম ধরা পড়লেও এই একটি মহামারি যার শুরু হয়েছিল আমাদের ভারতবর্ষের বাংলা অঞ্চলে। যাকে ‘ওলাওঠা’ রোগ বলা হত।
দুষিত পানি পানের জন্যই মুলত এটির সুত্রপত। এখন পর্যন্ত ৪ কোটির বেশি মানুষ মারা
গেছে কলেরায়। এই মহামারি থেকে বিশ্ব এখনও মুক্ত হয়নি ।
৫. স্পেনীস ফ্লু : প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরপর ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা নামের এক
বিরল রোগ দেখা দেয় আমেরিকায়। মারা যায় ৪-৫ কোটি মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে মৃত্যের সংখ্যা ১০ কোটি। এই রোগের উৎপত্তি আমেরিকায়
তারা এটি গোপন করতে চেয়েছিল কিন্তু স্পেনের সংবাদ মাধ্যম এই খবরটি মুক্তভাবে সারা
বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়।তাদের সাহসী ভুমিকার জন্য রোগটি ‘স্পেনিশ ফ্লু’ নামে পরিচিতি লাভ
করে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যত মানুষ মারা
গেছে তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল এই ইনফ্লুয়েঞ্জায় ।
৪ গুটিবসন্ত : ষোড়শ শতাব্দিতে শুরু
হয়েছে এই রোগ। এ পর্যন্ত ৫.৫ কোটি মানুষ মারা গেছে। কোথায় প্রথম পাওয়া গিয়েছিল তা এখনও অজানা
। যীশু খ্রিষ্টের জন্মের আগেও এই রোগকে
দেখা গেছে। এই রোগের মহামারি দেখা গিয়েছে
কয়েক শতাব্দি ধরে । আঠারো শতকে ইউরোপে গুটিবসন্তে প্রতিবছর ৪ লাখ লোক মারা যেত।
আক্রান্তে এক তৃতীয়াংশ হয়ে যেত অন্ধ । ১৯৭৯ সালে গুটিবসন্ত নির্মুলের ঘোষণা দেয়
বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা।
৩. যক্ষা : যক্ষা মাহামারির তালিকা সবচেয়ে উপরের একটি রোগ। কারন এখনও
প্রতিবছর ২২ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর মারা
যাচ্ছে যক্ষায়। ১৮৬৭ সালে কানাডায় দেখা দেয় প্রথম যক্ষা রোগ। এখন পর্যন্ত ১০০ কোটি মানুষ মারা গেছে যক্ষায়।
২. প্লেগ: মাহামারি আর প্লেগ যেন সমার্থক শব্দ। পৃথিবীতে কয়েক বার
এই প্লেগ আক্রমণ করে কেড়ে নিয়েছে কয়েক
কোটি মানুষের প্রাণ। এটিই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে টিকে থাকা মহামারির রোগ। প্রায় আড়াই হাজার
বছর ধরে এই রোগের সাথে মানুষ যুদ্ধ করে সে
পর্যন্ত জিতেছে মানুষ।
প্লেগ একটি ‘ইরসিন পেস্টিস’ নামের ব্যকটেরিয়া বাহিত
রোগ।
এখন
পর্যন্ত তিন ধরনের প্লেগ দেখা গিয়েছে পৃথিবীতে। কালো ইঁদুর থেকে এটি
ছড়িয়েছিল। আক্রান্ত ব্যক্তির কবজি বা বগলে কালো রঙ্গের ফোঁড়া ওঠে যা পরে সারা শরীরে
ছড়িয়ে পড়ে । এসসময় এগুলো পচে পুঁজ বের হতে থাকে। ৩-৭ দিনের মাথায় মৃত্যু
হয়। কয়েক শতাব্দি ধরে প্রায় কয়েকশ কোটি মানুষ মারা গেছে প্লেগে যার সঠিক হিসেব বের
করা অসম্ভব।
ইতিহাসে প্রথম প্লেগের খবর পাওয়া যায় এথেন্সে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৯ এ। এই মহামারি ‘এথেন্স প্লেগ’ নামে পরিচিত। ১ লাখ মানুষ মারা
পড়েছিল সেই সময়।
প্লেগের বিশাল এক মহামারি দেখা দেয়
মিশরে। খ্রিষ্টাব্দ ৫৪০ থেকে ৫৪১ সালে। রোমান সম্রাট জাস্টিয়ানেরও এই রোগ দেখা দেয়। ব্যাপক চিকিৎসার
ফলে যদিও ভালো হয়ে যান সম্রাট তবু তার নামে এই মহামারি ‘জাস্টিনিয়ান প্লেগ’ নামে পরিচিতি লাভ
করে
। প্রতিদিন
গড়ে ৫ হাজার মানুষ মারা যেত সেই সময়। সব মিলিয়ে ৩-৫ কোটি মানুষ মারা যায় এই মহামারিতে ।
এরপরের ভয়াবহ মহামারির নাম ‘ব্লাক ডেথ’ বা কালো মৃত্যু। মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয় বড় মহামারি। ১৩৪৭
সালে এই বিউবনিক প্লেগের দেখা দেয় ইউরোপে। ২০ কোটি মানুষ মারা যায়। ইউরোপ আর এশিয়া পরিনত হয় মৃত্যুপুরিতে । মাত্র চার বছরে এত মানুষ এর আগে কখনোই মারা
যায়নি পৃথিবীতে। পরের কয়েক শতাব্দি ধরে চলে এই মহামারি ।
১৭২০ এই ফ্রান্সে ১ লাখ মানুষ মারা
পড়ে বিউবোনিক প্লেগে। পরের শতাব্দিতে
১৮৫৫ সালে আবার দেখা দেয় প্লেগ, মারা যায় ১কোটি ২০ লাখ মানুষ ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য বলছে, প্লেগের মহামারি ছিল ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত। এরপর রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় । তবে ১৯৯৪ সালেও ভারতে এই রোগটি দেখা গেছে।
১. করোনা :
করোনা একটি ভাইরাসের নাম। এর ফলে যে রোগ হচ্ছে তাকে বলা হচ্ছে কভিড-১৯।
চীনের উহান শহর থেকে এর সুত্রপাত । ধারনা করা হচ্ছে প্রাণীর যে বাজার আছে উহানে
সেখান থেকে এটি ছড়াতে পারে। ২০১৯ সালের ৩১ এ ডিসেম্বর এটি প্রথম সনাক্ত হয় । এখন
পর্যন্ত এক লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছে তিন মাসে। সারা পৃথিবীর ২০০ টির বেশি
দেশ আক্রান্ত । আক্রান্তের সংখ্য ১৫ লক্ষ । শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে এটি ঠেকবে এই
সংখ্যা কেউ জানেনা।
পৃথিবীর ইতিহাসে একসাথে পুরো বিশ্ব লকডাউনের
ঘটনা এটিই প্রথম। মাত্র দুই মাসের মধ্যে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে ভাইরাসটি। এত দ্রুত এর আগে কোন
ভাইরাস বা মহামারি ছড়ায়নি পৃথিবীতে । সামান্য জ্বর সর্দি কাশি
আর শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছে মানুষ। বৃদ্ধরা বেশি মারা যাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকা আর
ইরান সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত । বাংলাদেশও আরকেটি মহামারির সামনে দাড়িয়ে । জানা যাচ্ছে না এই ক্ষুদ্র ভাইরাসটি পৃথিবীকে
ধ্বংসের কোন প্রান্তে নিয়ে যাবে? কত মানুষ
মারা পড়বে? আর কত বছর এটি মানুষকে মেরে
ফেলতেই থাকবে? আর কতদিন মানুষ অসহায় আত্নসমর্পণ করে যাবে এই অজানা অদেখা শক্র করোনার
কাছে তা কেউ জানেনা। তবে মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। করোনাকে পরাজিত করে
একদিন মানুষই জিতবে এই যুদ্ধে, সেই দিন পর্যন্ত শুধু অপেক্ষা ।
পারভেজ সেলিম
সাংবাদিক ও লেখক
0 Comments