মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক।।
৩ বছর ধরে প্রায় ৩,০০০ শ্রমিকের
(যাদের মাঝে কাজ চলাকালে ২ জন মারা যায়) মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গড়ে ওঠে প্রায় ৯টি
নীল তিমির সমান লম্বা (৮৮২ ফুট ৯ ইঞ্চি) এই জাহাজটি।
টাইটানিক বানাতে কত খরচ হয়েছিল বলতে পারেন? সেই আমলের হিসাবে ৭.৫ মিলিয়ন মানে ৭৫ লক্ষ ডলার। ইন্টারনেটে
বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আপনি বছরে বছরে অর্থের মূল্য কীভাবে পাল্টে যায় সেটার হিসাব
করতে পারবেন। কয়েকটা ওয়েবসাইট ঘুরে দেখলাম,
২০২০
সালের হিসাবে এই অঙ্কটা ২০০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বাংলাদেশি টাকাতে কত বলতে
পারেন? ১৬৮৯ কোটি টাকারও বেশি!
সর্বোচ্চ ৩,৫৪৭ জনের
ধারণক্ষমতা থাকলেও জাহাজটিতে সেদিন সব মিলিয়ে যাত্রী ছিল ২,২২৩ জন। তবে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, শুরুতে জাহাজটিতে লাইফবোট ছিল ৬৪টি, যেখানে ৩,৫৪৭ জনের সবাই-ই জায়গা করে নিতে পারত। কিন্তু ঐ যে 'আনসিঙ্কেবল শিপ'
নামের
একটা অহঙ্কার জায়গা করে নিয়েছিল কর্তৃপক্ষের মনে। তাই তারা এত লাইফবোটকে বাহুল্য
মনে করল। টাইটানিকে জায়গা পেল মাত্র ২০টি লাইফবোট, যা মূল পরিকল্পনার ৩ ভাগের ১ ভাগও না। এতে জায়গা হতো ১,১৭৮ জন যাত্রীর।
সেই আমলে ফার্স্ট ক্লাসের একটা টিকিটের দাম ছিল ৮৭০ পাউন্ড। এর বিপরীতে পুল, জিমনেশিয়াম, টার্কিশ বাথ,
স্কোয়াশ
কোর্ট, ক্যাফে, ডাইনিং স্যালনসহ বহুত সুবিধাই পেয়েছিলেন
ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রীরা।
অন্যদিকে থার্ড ক্লাসের একটা টিকিটের দাম ছিল 'মাত্র' ৩ পাউন্ড, যেখানে সেই যাত্রীদের জন্য সাধারণ রুম, ২টি বাথটাব আর সাধারণ ডাইনিং স্যালনই ছিল।
একটা ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট এখানে জানিয়ে রাখি, টাইটানিকে কোনো রুমের নাম্বারই কিন্তু ‘১৩’ ছিল না!
২,২২৩ জন যাত্রীর জন্য
খাবারদাবারের কোনো কমতি ছিল না। ৭৫,০০০ পাউন্ড ফ্রেশ
মাংস নেয়া হয়েছিল, যার মাঝে ২৫,০০০ পাউন্ডই ছিল হাঁস-মুরগির। ১৬,৮৫০ বোতল বিয়ার,
স্পিরিট, ওয়াইন ছিল; ছিল ১,০১,০০০ ফল আর ৪০,০০০ ডিম। এগুলো
খাওয়ার জন্য নেয়া হয়েছিল ১,৩০,০০০ পিস ক্রোকারিজ সামগ্রী। প্রতিদিন দরকার হতো ১৪,০০০ গ্যালন পানি,
সুমিষ্ট
পানি যাকে বলা হয় সেটাই।
টাইটানিক কেবল মানুষ আর খাবারই নেয়নি,
রয়্যাল
মেইল শিপ হিসেবে এতে ৩,৩০০ ব্যাগের বেশি
চিঠিপত্রও ছিল, যাতে থাকা মোট
চিঠিপত্রের সংখ্যা ৭০ লক্ষেরও বেশি। এই দানবকে চালিয়ে নিতে জাহাজটির ২৯টি বয়লারে
প্রতিদিন ৬৫০ টন করে কয়লা পোড়ানো হতো।
১৪ এপ্রিল রাত ১১টা ৪০ মিনিটে বিশালাকায় বরফখণ্ডটির দেখা মেলে। কিন্তু ঠিকমতো
কিছু করবার সময়ই পাওয়া গেল না। কারণ,
মাত্র
৪০ সেকেন্ডের ভেতরেই সংঘর্ষ হয় টাইটানিকের সাথে আইসবার্গের। সাথে সাথেই জাহাজটির
৫টি এয়ারটাইট কম্পার্টমেন্ট ভেঙে পানি ঢুকে যায়। ২২.৫ নট অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় ২৬
মাইল বেগে বরফখণ্ডটির সাথে সংঘর্ষ হয়েছিল টাইটানিকের।
রাত তখন ১২টা, অর্থাৎ তারিখের
হিসেবে ১৫ এপ্রিল শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্যাপ্টেন সাহায্য চাইলেন নিকটবর্তী
জাহাজগুলোর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিকটবর্তী জাহাজ কার্পেথিয়াও তখন ৫৮ মাইল দূরে।
নিকটবর্তী স্থলভূমি থেকে তখন টাইটানিকের দূরত্ব প্রায় ৪০০ মাইল।
রাত পৌনে একটার দিকে প্রথম লাইফ বোটটি নামানো হয়। এখানে সর্বোচ্চ ৬৫ জন বসতে
পারলেও তাড়াহুড়ার কারণে অর্ধেকেরও কম,
অর্থাৎ
২৭ জন বসেছিল সেই প্রথম লাইফ বোটটিতে।
রাত ২টা ১০ মিনিটে জাহাজের সব লাইট অফ হয়ে যায়। এর মাত্র ৮ মিনিটের মাথায় ভেঙে
দু’টুকরো হয়ে যায় পুরো
জাহাজটি, যেমনটা দেখিয়েছিল টাইটানিক
সিনেমাতে। এরপর আর খুব বেশি সময় লাগলো না পুরোটা ডুবতে। মাত্র ২ মিনিটের মাঝেই
সমুদ্রের বুকে তলিয়ে গেল ৪৬ হাজার টনের এই ‘আনসিঙ্কেবল’ দানব।
পানির তাপমাত্রা তখন মাত্র ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সমুদ্রের পানিতে ভেসে থাকা
মানুষগুলোও তাই খুব বেশি সময় টিকতে পারেনি। গড় হিসেবে, একেকজন মাত্র ১৫ মিনিটের মতো টিকে ছিল। এরপর
তীব্র ঠাণ্ডায় তারাও পরপারে পাড়ি জমায়। ঠিক সিনেমার জ্যাকের মতোই।
.
রাত সাড়ে ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় কার্পেথিয়া। ততক্ষণে মারা গিয়েছে
জাহাজটি ১৫ শতাধিক যাত্রী। পরদিন জীবিত ৭০৫ জনকে নিয়ে সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে নিউ
ইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে কার্পেথিয়া। ৩ দিন পর অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল রাত ৯টায়
গন্তব্যস্থলে পৌঁছায় জাহাজটি।
এবার আসা যাক বাঁচা-মরার হিসেবে। এটাও অনেকটা ক্লাসের দ্বারা প্রভাবিত।
হিসাবটা দেখলেই বুঝতে পারবেন:
ফার্স্ট ক্লাস – জীবিত ৬৩%, মৃত ৩৭%
সেকেন্ড ক্লাস - জীবিত ৪২%, মৃত ৫৮%
থার্ড ক্লাস - জীবিত ২৫%, মৃত ৭৫%
ক্রু - জীবিত ২৩%, মৃত ৭৭%
সমুদ্রের প্রায় ২.৩ মাইল নিচে তলিয়ে যায় টাইটানিক। অন্যভাবে বলতে গেলে, নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংকে একটার
উপর একটা করে মোট ১০টা সাজালে যে উচ্চতা হয়,
সেই
সমপরিমাণ গভীরেই তলিয়ে গিয়েছিল জাহাজটি। এর ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে সমুদ্রের নিচে ১৫
মাইল এলাকা জুড়ে।
ডুবে যাবার ৭৩ বছর পর ১৯৮৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর রবার্ট ব্যালার্ড আরএমএস
টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। টাইটানিক রিলিফ ফান্ডের অধীনে এই দুর্ঘটনায়
ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে তুলে দেয়া অর্থের পরিমাণ বর্তমান হিসেবে প্রায় ৩১.৪ মিলিয়ন
মার্কিন ডলার বা প্রায় ২৬৫ কোটি টাকা। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত এই ফান্ডটি চালু ছিল।
টাইটানিকের করুণ পরিসমাপ্তির স্মৃতিকে নিয়ে ফেরত এসেছিলেন ৭০৫ জন। কালক্রমে
তারাও একে একে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। এদের মাঝে সর্বশেষ ছিলেন মিল্ভিনা ডিন। ২০০৯
সালে প্রায় মারা যান তিনি। টাইটানিক ডুবে যাবার কালে তার বয়স ছিল মাত্র ২ মাস।
মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক
লেখকের ফেসবুক থেকে
0 Comments