করোনায় পুরো পৃথিবী এখন বিধস্ত। কিন্তু করোনা কোন রোগের নাম নয় এটি একটি ভাইরাস । এর ফলে যে রোগ হচ্ছে তার নাম ‘কোভিড-১৯’। সবার মুখে এখন রোগের চাইতে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে এই জীবানুর নাম। পৃথিবীতে মরণঘাতি কিছু ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়ারের কারনে বারবার দেখা দিয়েছে মহামারি। আর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে কোটি কোটি মানুষের। আজ আমরা এমন কিছু ভয়ানক জীবানুর দিকে নজর দিতে চাই।
১. ইরসিনা
পেস্টিস : পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মহামারির রোগের
নাম ‘প্লেগ’। আর এই প্লেগের জীবানুর নাম ‘ইরসিনা
পেস্টিস’। এই ব্যাকটেরিয়া প্রথম কালো ইঁদুর থেকে
মানুষের শরীরে এসেছিল। ১৩৪৬-৫৩ সালের প্লেগে মারা গিয়েছিল ৭-২০ কোটি মানুষ। ১৮৯৭ সালে আবিস্কার হয় এর টিকা। তারপরও এই ভয়ানক ব্যাকটেরিয়ার মহামারি চলেছিল ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত ।
২. ভিব্রিও
কলেরি : ভয়াবহ এই
ব্যাকটেরিয়ার কারনে যে রোগ হয় তার নাম কলেরা। মুলত দূষিত পানিতে এই ব্যাকটেরিয়া থা্কে। খাবারের মাধ্যমে এটি মানুষের শরীরে
প্রবেশ করে। ১৮২০ সালে কলেরার
কারণে বিশাল এক মহামারি দেখা দিয়েছিল ভারতে। প্লেগের টিকা আবিস্কারের পর ইউক্রেনের জীবানুবিদ ওয়াল্ডেমার হফকিন্স
আবারও কলেরা টিকাও আবিস্কার করেন। সময়টা ১৮০০ সালের শেষ দিকে।
সবচেয়ে মারাত্বক এই ব্যাকটেরিয়া দুটিকে মানুষ নিয়ন্ত্রণ
করতে পেরেছে । তবে মানুষ এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সকল ভাইরাসকে। ভাইরাসই
মানুষের চিন্তার কারণ। এবার কিছু দূর্ধর্ষ ভাইরাসের খোঁজ খবর করা যাক।
১. ভ্যারিওলা: ভ্যারিওলা মেজর ও ভ্যারিওলা মাইনর নামের দুটি ভাইরাস মুলত গুটিবসন্তের কারণ। গত
১০০ বছরে ৫০ কোটির বেশি মানুষ মারা গেছে এই ভাইরাসের আক্রমণে। ১৭৯৬ সালে প্রথম এর টিকা আবিস্কার হলেও লক্ষ
লক্ষ মানুষ মারা গেছে এই গুটিবসন্তে। ১৯৫৭-১৯৭৭ সালে টিকার ব্যাপক উন্নতি ও ব্যবহারের ফলে গুটিবসন্ত
কমে আসে পৃথিবীতে। ভ্যারিওলা
ভাইরাস মানুষের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে ।
২. ইনফুলেঞ্জা : প্রথম বিশ্ব
যুদ্ধের পর ১৯১৮-১৯১৯ সালে ৫ কোটি মানুষ মারা গেছে এই ভাইরাসে। এর রোগটি ‘স্প্যানিশ ফ্লু’
নামেও বেশ পরিচিত। শুকুরের শরীর থেকে এই
ভাইরাস প্রথম মানুষের শরীরে আসে। তবে বর্তমানে এটি শুকুর ও পাখি ও
মানুষের শরীরের সংমিশ্রনে একটি নতুন ভাইরাস সৃষ্টি করেছে। যার নাম এইচ১এন১।
১৯৩০ সালে এর টিকা আবিস্কার হয়। এটি
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল ভাইরাসের টিকার উদাহরন।
৩. পোলিও: বেশির ভাগ ভাইরাস বা
ব্যাকটেরিয়া অন্য কোন প্রানী থেকে মানুষের শরীরে এসেছে। তবে গুটিবসন্ত ও
পোলিওভাইরাস প্রথম থেকেই মানুষের শরীরেরই ছিল। মুলত খাবার বা মানুষের লালার মধ্য
দিয়ে এটি অন্যের শরীরে পৌঁছায়। ১৯৫০ সালে এর টিকা আবিস্কার হয়। তবে পোলিও এখনও পুরোপুরি নির্মুল
হয়নি পৃথিবী থেকে। তবে আনন্দের সংবাদ ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে সম্পূর্নরুপে
পোলিওমুক্ত ঘোষণা করে ।
৪. ইবোলা: ২০১৪-১৫ সালে ইবোলা ভাইরাসে
মারা গেছে ১১ হাজার মানুষ। বাদুড়
থেকে মানুষে ছড়িয়েছিল এই ভাইরাস। কঙ্গো, সুদান, আইভরিকোষ্টে এর আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। শুধুমাত্র রক্ত বা শরীরের রসের সংস্পর্শে এটি ছড়ায় । ৯০ শতাংশ
মানুষ মারা যায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে।২০১৯
এর ডিসেম্বরে এর টিকার ব্যবহার শুরু হয়। সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে আবিস্কার করা সম্ভব
হয়েছে এর টিকা।
এই চার মরণঘাতি ভাইরাসকে তবু নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে
মানুষ। তবে আরো ভয়ানক কিছু ভাইরাস আছে যাদের মানুষ এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি ।
৫. এইচআইভি : এইডসের ভাইরাসের নাম
এইচআইভি । বানর থেকে
মানুষের শরীরে আসে এই ভাইরাস সেটাও পঞ্চাশের দশকে। ১৯৮০ সালের দিকে মানুষ এই
ভাইরাসের চরিত্র বুঝতে পারে। এর আক্রমণে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায় । তখন হালকা রোগেই যেকেউ মারা যায়। ২০১৭ সালের হিসেবে ৩ কোটি
৫০ লক্ষ মানুষ মারা গেছে এইডসে। এখনও এই
ভাইরাসের কার্যকরি কোন টিকা আবিস্কার হয়নি। তবে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির
মৃত্যুকে কিছুদিন বিলম্বিত করার কৌশল আবিস্কার করতে পেরেছে মানুষ।
৬. সার্স ও মার্স : বাদুড়ে এবং
খাটাস জাতীয় বিড়াল থেকে এসেছে সার্স ভাইরাস। ২০০২
ও ২০০৪ সালে চীনে দুইবার দেখা দিয়েছিল এই ভাইরাসের আক্রমণ।
আর মার্স ভাইরাস এসেছে উট থেকে। মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। করোনা ভাইরাসের গোত্রের বলেই এর নাম ‘নোবেল করোনা মার্স ভাইরাস’। এখনও কোনও প্রমাণিত টিকা আবিস্কার হয়নি সার্স ও মার্স ভাইরাসের।
আর মার্স ভাইরাস এসেছে উট থেকে। মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। করোনা ভাইরাসের গোত্রের বলেই এর নাম ‘নোবেল করোনা মার্স ভাইরাস’। এখনও কোনও প্রমাণিত টিকা আবিস্কার হয়নি সার্স ও মার্স ভাইরাসের।
৭. জিকা: ১৯৪৭ সালে উগান্ডায় প্রথম
বানর থেকে এটি ছড়িয়ে পড়ে। এডিস মশার
মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে মানুষের শরীরে। এই
ভাইরাসে আক্রান্ত গর্ভবতী নারীরা ছোট মাথা
ওয়ালা শিশু জন্ম দিচ্ছে। এখন
কার্যকরী কোন টিকা আবিস্কার হয়নি । কারো
কারো মতে এটির টিকা আসতে আরো দশ বছর সময় লাগতে পারে।
৮. করোনা : বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর
ভাইরাসের নাম করোনা। এই ভাইরাসটি সামুদ্রিক কোন প্রাণী কিংবা পশুপাখি থেকে
মানুষের শরীরে ছড়িয়েছে। চীনের উহান প্রদেশের প্রাণীর বাজার থেকে এটি ছড়িয়েছে বলে
মনে করছেন অনেকে।
আক্রান্ত ব্যক্তি জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যাথা এবং
শেষে শ্বাসকষ্টে কয়েকদিনের মধ্যেই মুত্যূ
বরণ করেন। না
জানি কত মানুষ মারা যাবেন এর টিকা আবিস্কারের আগেই ! কারন কেউই দেড় থেকে দুবছরের
আগে এর টিকা আবিস্কারের কোন আশ্বাস দিতে পারছেনা ।
পেনিসিনিল আবিস্কারের পর ব্যাকটেরিয়াকে মানুষ ঘায়েল
করতে পেরেছে কিন্ত ভাইরাস এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অনেক ভাইরাসের টিকা
মানুষ এখনও আবিস্কার করতে পারেনি। তবে মানুষের অসাধ্য কিছু নাই। মানুষ অবশ্যই একদিন পরাজিত করতে পারবে
এই ক্ষুদ্র ভয়ানক ভাইরাসকেও ।
পারভেজ সেলিম
সাংবাদিক ও লেখক
0 Comments