কুদরত-ই-হুদা
ঊনবিংশ
শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষার হাত ধরে বাংলায় যে ‘আধুনিকতা’ প্রবেশ
করে, তা ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিন্তাজগতে
একটা ঘোরতর আলোড়ন তোলে। প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতি যেহেতু জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ
অনুষঙ্গ, তাই স্বাভাবিক নিয়মেই এখানেও ইউরোপ-আগত প্রেমের
ধারণা একটা বড়সড় ধাক্কা দেয়। বন্যার পানির মতো প্রেমের উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে শিক্ষিত
বাঙালি মধ্যবিত্তের মনের দোরগোড়ায়। এই নতুন প্রেমের উচ্ছ্বাস কতটা প্রবল ছিল,
তা নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর আত্মঘাতী বাঙালি বইয়ে সবিস্তারে বর্ণনা
করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাঙালি
জীবনে ইউরোপ হইতে আনা “রোমান্টিক” প্রেম সেই যুগেই বাংলাদেশে বিলাত হইতে
আনা নতুন গোলাপের মত ফুটিতে লাগিল।’ বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন এই নতুন গোলাপের প্রথম বাগানি।
নীরদের ভাষায়, ‘বঙ্কিমচন্দ্র
বাঙালি জীবনে নূতন “রোমান্টিক” প্রেমের প্রবর্তক।’
রবীন্দ্রনাথের
প্রজন্মে এসে ইউরোপীয় শিক্ষার মধ্য দিয়ে আগত এই রোমান্টিক প্রেম দাম্পত্য জীবনের
অন্দরমহল পর্যন্ত ঢুকে পড়ে। এর প্রমাণ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ আর বিংশ শতাব্দীর প্রথম
দিককার স্ত্রীদের লেখা চিঠিতে পাওয়া যাবে বলে নীরদচন্দ্র উল্লেখ করেছেন। স্ত্রীদের
লেখা চিঠিতে প্রেমের এত আতিশয্য থাকত যে সেসব চিঠি প্রাপকের কাছে পৌঁছাত না। তার
আগেই সেগুলো খুলে পড়ে ফেলত পিয়নরা। কখনো কখনো পিয়নকে টাকা দিয়ে যুবক ছেলেরা সেগুলো
পড়ত। এ কারণে এক স্ত্রী নাকি খামের ওপর লিখে দিয়েছিল, ‘পিয়ন রে! করজোড়ে করি নিবেদন,/মালিক
বিহনে চিঠি না দিয়ো কখন!’
বৈষ্ণব
পদাবলীর পরে বাঙালি তার বিচিত্র প্রেমানুভূতি সবচেয়ে বেশি খুঁজে পেয়েছে
রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শ্রীচৈতন্যদেবের
পৌরহিত্যে ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার আপামর জনসাধারণ যে প্রেমরস সাগরে ভেসেছিল,
তার উৎস স্বদেশ। আর বঙ্কিমের প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে
বাংলায় যে প্রেমরসের সমাবেশ ঘটল, তার প্রেরণা ও উৎস মূলত
ইউরোপ। উৎস বা প্রেরণা যা-ই হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথের কলমের
ডগা আর মনের সংযোগে বাংলা কবিতায় প্রেমের যে জগৎ গড়ে উঠল, তার
ব্যবহার ছাড়া সমকালীন শিক্ষিত বাঙালির প্রেমানুভূতির যেন পূর্ণ প্রকাশ হতো না।
এখন
রবীন্দ্রনাথের প্রেমের ধারণার স্বাদ-গন্ধ দ্রুত চেখে নেওয়া যাক, যা
শিক্ষিত ‘আধুনিক’ বাঙালি সমাজ শুধু সমকালে নয়, প্রায় সোয়া শতাব্দী ধরে ব্যবহার করছে নিজের প্রেমানুভূতিকে প্রকাশ করার
জন্য।
রবীন্দ্রনাথ
জন্ম-রোমান্টিক কবি বলে বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবি রবীন্দ্রনাথ বইয়ে দাবি করেছেন।
রোমান্টিকদের যে যে বৈশিষ্ট্য থাকে, তার সবই রবীন্দ্রনাথের
মধ্যে ছিল অত্যন্ত প্রকট। তীব্র কল্পনাপ্রবণতা, সুদূরের
প্রতি আকর্ষণ, সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির
প্রতি বাঁধভাঙা আকর্ষণ রবীন্দ্র প্রতিভার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্য
রবীন্দ্রনাথের প্রেমানুভূতিকে দারুণভাবে শাসন করেছে। ফলে প্রেমানুভূতির জন্য
রবীন্দ্রনাথের কাছে নারীর প্রত্যক্ষ শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজন হয়নি। বরং নারীর
শারীরিক উপস্থিতিকে তিনি প্রেমের অন্তরায় বলে মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন,
কাঙ্ক্ষিত নারী যখন কল্পনা থেকে বাস্তবের মধ্যে চলে আসে, কল্পনার অসীম থেকে সংসারের সীমার মধ্যে চলে আসে, তখন
প্রেম আর থাকে না। কারণ ‘অনন্ত
আকাশের ফাঁক না পেলে বাঁশি বাজে না’। এ কারণে একসময় যে নারী ছিল সংসার-সীমার বাইরে কল্পনার মায়াঞ্জন
মাখা,
সে যখন সংসারের মধ্যে এসেছে তখন ওই নারী আবিষ্কার করেছে যে তাদের
মধ্যে আগের সেই প্রেমের তীব্রতা নেই। নারী নিজেই তাদের প্রেম ফুরিয়ে যাওয়ার
ব্যাখ্যা করেছে এভাবে, ‘এখন
হয়েছে বহু কাজ,/ সতত রয়েছ অন্যমনে।/ সর্বত্র ছিলাম আমি/ এখন এসেছি
নামি/ হৃদয়ের প্রান্তদেশে, ক্ষুদ্র গৃহকোণে।’ (‘নারীর
উক্তি’, মানসী)
প্রেমিক পুরুষকে দিয়েও রবীন্দ্রনাথ তাঁর একই কাব্যের ‘পুরুষের উক্তি’ কবিতায় একই কথা বলিয়েছেন, ‘কেন মূর্তি হয়ে এলে/ রহিলে না ধ্যান
ধারণার?’ রবীন্দ্রনাথের প্রেম সম্পর্কিত এই
ধারণা ইউরোপীয় রোমান্টিক কাব্যধারার হাত ধরে এসেছে।
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর প্রেমের প্রশ্নে ছিলেন আদ্যোপান্ত বিশুদ্ধতাবাদী। প্রেমের ক্ষেত্রে শরীরকে
তিনি বরাবরই গৌণ মনে করতেন। বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায় তাঁর বিখ্যাত ‘সুরদাসের প্রার্থনা’ কবিতায়। ওই কবিতায় কবি তাঁর প্রেয়সীকে
দেবী সম্বোধন করে বলেছেন, ‘আনিয়াছি
ছুরী তীক্ষ্ণ দীপ্ত প্রভাত রশ্মিসম— / লও, বিঁধে দাও বাসনাসঘন এ
কালো নয়ন মম।/ এ আঁখি আমার শরীরে তো নাই, ফুটেছে মর্মতলে—/ নির্বাণহীন অঙ্গারসম নিশিদিন শুধু
জ্বলে।/ সেথা হতে তারে উপাড়িয়া লও জ্বালাময় দুটো চোখ— / তোমার লাগিয়া তিয়াষ যাহারা সে আঁখি
তোমারি হোক।।’ অন্ধ
হয়ে গেলে যা হবে তা-ই তো সুরদাসের তথা কবির আরাধ্য, ‘হৃদয়-আকাশে থাক-না জাগিয়া দেহহীন তব
জ্যোতি’। এ কারণে
উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর রবীন্দ্রকাব্য-পরিক্রমা গ্রন্থে বলেছেন, ‘যে প্রেম বুভুক্ষিত দৃষ্টিতে দেহের
চারিপাশে ঘুরিয়া মরে, ব্যক্তি-মানুষের বাস্তব দেহ-মন যাহার ভিত্তি,
সেই আবেগময়, আত্মহারা, সাধারণ
মানুষের প্রেম রবীন্দ্রনাথের প্রেম নয়।...প্রেম অসীম, অনন্তের
ধন, আত্মার সম্পদ, দেহের সীমায় তাহাকে
ধরা যায় না। দেহসম্বন্ধ বিরহিত, অপার্থিব সৌন্দর্যের নিবিড়
অনুভূতি এক অনির্বচনীয় আনন্দরস।’ কবির ভাষায়, ‘লও তার মধুর সৌরভ,/ দেখো তার সৌন্দর্য বিকাশ,/ মধু তার করো তুমি পান,/ ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী/ চেয়ো না তাহারে।/ আকাঙ্ক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের।’ (‘নিষ্ফল
কামনা’, মানসী)
মধ্যযুগের বাংলা কবিতার শারীরিক প্রেমের সাপেক্ষে এই প্রেম নতুনই বটে। প্রেমের এই
ধারণা যে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গোগ্রাসে গ্রহণ করবে তা বলাই বাহুল্য।
আদতে হয়েছেও তা-ই।
রবীন্দ্রনাথ
ও কালিদাসের কবিপ্রতিভা ও জীবনচেতনার তুলনা করতে গিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর শাশ্বত
বঙ্গ বইয়ের ‘কালিদাস ও
রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে
যে কথা বলেছেন, তা রবীন্দ্রনাথের প্রেমচেতনা বোঝার ক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন, ‘কালিদাস যথেষ্ট ভোগবাদী...কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আনন্দবাদী; কালিদাসের
সৌন্দর্য-বোধ ও রসবোধের চাইতে সূক্ষ্মতর রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-বোধ ও
রসবোধ।...কালিদাসের ভোগবাদ রবীন্দ্রনাথ যেন সজাগভাবেই শোধিত করে নিয়েছেন।’ ‘সহসা
অসমাপ্ত গানে’ থামাই
রবীন্দ্রনাথের মূল স্বভাব। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় রবীন্দ্রনাথের কল্পনা কাব্যের ‘স্বপ্ন’ কবিতাটির কথা। সেখানে কবি ‘পূর্ব জনমের প্রথমা প্রিয়া’র সঙ্গে দেখা করেছেন। পরস্পর পরস্পরের
কাছে এসেছেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ যে বর্ণনা দিলেন, তা তাঁর
প্রেমবিষয়ক ধারণাকে স্পষ্ট করে তুলেছে,‘মোরে হেরি প্রিয়া/ ধীরে ধীরে দীপখানি দ্বারে নামাইয়া/ আইল সম্মুখে, মোর
হস্তে হস্ত রাখি/ নীরবে শুধালো শুধু, সকরুণ আঁখি,/ “হে বন্ধু, আছ তো ভালো?” মুখে তার চাহি/ কথা বলিবারে গেনু কথা
আর নাহি।/ সে ভাষা ভুলিয়া গেছিÑনাম দোঁহাকার/ দুজনে ভাবিনু
কত মনে নাহি আর।/ দুজনে ভাবিনু কত চাহি দোঁহা-পানে,/ অঝোরে
ঝরিল অশ্রু নিস্পন্দ নয়ানে।’ প্রেমের এই শালীন, শৈল্পিক আর
সূক্ষ্ম রূপই ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সেদিন উন্মাতাল করেছিল;
আবিষ্ট করেছিল। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে এই শ্রেণি প্রেম সম্পর্কে যে
ধারণা আর রুচি অর্জন করেছে, সেই ধারণা আর রুচিরই প্রতিফলন সে
লক্ষ করেছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে। এই রুচিকে যদুনাথ সরকার শনিবারের চিঠির
রবীন্দ্র সংখ্যায় ‘রবীন্দ্রনাথের
একটি দান’ প্রবন্ধে
ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছেন, ‘মার্জ্জিত
রুচি’। বলা বাহুল্য, এই
‘মার্জ্জিত রুচি’ রবীন্দ্রনাথ অর্জন করেছিলেন ইংরেজি
কাব্য-কবিতা পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ
যেহেতু ইউরোপের ভিক্টোরিয়ান আদর্শবাদ দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন, সেহেতু
তিনি প্রেমের প্রশ্নেও বিশুদ্ধতাবাদী। এ কারণে আমরা তাঁর প্রেমের কবিতায় নারীকে
প্রায়শই ধরতে-ছুঁতে পারি না। ধরা ও ছোঁয়ার অনুভবের বাইরে বসবাস রবীন্দ্রনাথের
নারীদের।চিত্রা কাব্যের ‘বিজয়িনী’ কবিতায় তাই প্রেমের দেবতাকেও দেখা যায়
বিজয়িনীর পদপ্রান্তে তির-ধনুক সমর্পণ করে তাকে দেবীর মতো প্রণাম করতে। নারীর দেবীর
মহিমায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি রবীন্দ্রনাথে এত স্পষ্ট যে উদাহরণের দরকার পড়ে না। এ
ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পাশে নজরুলের নারীপ্রেমের কবিতাকে রাখলে বিষয়টি স্পষ্টভাবে
বোঝা যায়। নজরুলের কাঙ্ক্ষিত নারী কবিতায় শারীরিকভাবে এত স্পষ্ট যে চাইলেই যেন তার
চিবুকটা ছুঁয়ে দেখা যায়, তার শারীরিক অস্তিত্ব অনুভব করা
যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নারী যেন রক্ত-মাংসের নারী নয়, দেবী।
রবীন্দ্রনাথের নারীর এই দেবীতে রূপান্তরিত হওয়ার পেছনে বোধ করি রবীন্দ্রনাথের
আবাল্য সংস্কারের মধ্যে দেবীমূর্তির উপস্থিতি ক্রিয়া করে থাকবে। আর ইউরোপীয় ‘পিউরিট্যানিজ্ম’ বা বিশুদ্ধতাবাদী চিন্তার
ব্যাপার-স্যাপার তো আছেই।
রবীন্দ্রনাথের
প্রেমচেতনার যে পরিচয় পাওয়া গেল, তা মূলত ইউরোপীয় রেনেসাঁসের চেতনায়¯স্নাত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই প্রেমের ধারণা এবং
প্রকাশরীতি প্রায় সোয়া শতাব্দীব্যাপী শিক্ষিত বাঙালির প্রেমাবেগ প্রকাশের প্রধান
উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। ভবিষ্যতেও রবীন্দ্রনাথ এই শ্রেণির প্রেমের
অনুভূতি প্রকাশের বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হবেন—এমন ধারণা অমূলক নয়। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের
প্রেম সম্পর্কিত আবেগ আর ধারণার পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তমানতার সূত্র ধরে
রবীন্দ্রনাথের পরে জীবনানন্দ দাশ এবং রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের অপরাপর কবিদের
ব্যবহারও কম হয়নি। কিন্তু এককভাবে রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই বোধ করি বাঙালি তার
প্রেমানুভূতির সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পায়।
যত
দিন পর্যন্ত না শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রেম সম্পর্কিত নিজস্ব নতুন
ধারণা দাঁড় করাতে পারবে, প্রেমের নিজস্ব ভাষা দাঁড় করাতে না পারবে, তত দিন বাঙালির রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ
রবীন্দ্রনাথের মতো প্রেমিক পুরুষ বোধ করি বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় নেই। তাঁর মতো
সবল, সুস্থ, স্বতঃস্ফূর্ত, সূক্ষ্ম প্রেমের প্রকাশ আর কোনো কবির মধ্যে দেখা যায় না। তাঁর প্রেমভাবের
প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, এর সঙ্গে কবি গভীরভাবে লিপ্ত থাকেন;
সপ্রাণতার সঙ্গে লিপ্ত থাকেন; নারীভাবে লিপ্ত
থাকেন। এ কারণে রবীন্দ্রনাথের মানবপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেম,
প্রকৃতিপ্রেম, নারীপ্রেম সমান আবেগ আর
আন্তরিকতায় রূপায়িত।
রবীন্দ্রনাথের
প্রকৃতিপ্রেমের যেকোনো কবিতাকে বা ঈশ্বরপ্রেমের যেকোনো কবিতাকে শিক্ষিত বাঙালি
প্রেমিক তার প্রেমিকার উদ্দেশে নিবেদন করতে পারে। এবং যুগে যুগে করেছেও তাই।
রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে এ ঘটনা বোধ করি সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ যখন
বলেন,
‘কি দেখিছ, বঁধূ
মরমমাঝারে রাখিয়া নয়ন দুটি।/ করেছ কি ক্ষমা যতেক আমার স্খলন পতন ত্রুটি!’; অথবা যখন বলেন, ‘আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে/ হে সুন্দরী?/ বলো কোন পারে ভিড়িবে তোমার/ সোনার তরি।/ যখনই শুধাই, ওগো বিদেশিনী,/ তুমি হাস শুধু মধুরহাসিনী/ বুঝিতে না পারি, কী জানি কী আছে/ তোমার মনে।’ তখন প্রকাশ আর অনুভবের গভীরতায় মনে হয়
এ বুঝি প্রেমিকার উদ্দেশে প্রেমিকের কথা। কিন্তু চিত্রা ও সোনার তরি কাব্যের ‘জীবন দেবতা’ ও ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ নামক কবিতা দুটি আদৌ নারীপ্রেমের
কবিতাই নয়। এভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভুলভাবে কিন্তু অব্যর্থ উদ্দেশ্যে যুগ যুগ
ধরে শিক্ষিত বাঙালি প্রেমিক হৃদয়ের অব্যক্ত কথাকে ব্যক্ত করে চলেছে।
তবে
কি রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা সাহিত্যে প্রেমের নিজস্ব নতুন ধরন ও প্রকাশরীতি
দাঁড়ায়নি! শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি কি তবে চেতনায়, বোধে আর
সৃজনশীলতায় ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় প্রেমচেতনার লিগ্যাসি বহন করছে! কিন্তু
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাইরে গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বিরাট বাঙালি
জনগোষ্ঠী তাদের প্রেমানুভূতির জন্য নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথকে বেছে নেয় না। এ ক্ষেত্রে
তারা হয়তো লালন, হাসন রাজা, রাধারমণ,
জসীমউদ্দীন, শাহ আবুদল করিম, বিজয় সরকার বা এ রকম অপরাপর কবিদের মধ্যে নিজেদের প্রেমের ভাব আর ভাষা
খুঁজে পায়। ঔপনিবেশিক বাস্তবতার মধ্যেই তো এই ঘটনাটা ঘটেছে! আজও রবীন্দ্রনাথের
প্রেমভাব আর ভাষার এই নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার তবে কি শিক্ষিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর
অনগ্রগতিকে নির্দেশ করে, নাকি নিজের কথা নিজের মতো করে বলতে
না পারার ব্যর্থতা! নাকি এটি প্রেমিক হৃদয় রবীন্দ্রনাথেরই অগ্রবর্তী চৈতন্যের
পরিচায়ক!
কুদরত-ই-হুদা
সৌজন্যে : প্রথম আলো ৪ মে ২০১৮
0 Comments