রেইজ দ্যা রেড লন্ঠন : অসাধারণ এক চাইনিজ মাস্টারপিস



শিল্পিত পারু ।।

বাংলায় লন্ঠন মানে হারিকেন বা বাতি। গ্রামে এখনও সবাই আলো দেবার এই বস্তুটিকে লন্ঠন নামেই চেনে । শব্দটি ফ্রেন্স থেকে হয়ত ইংরেজরা নিয়েছে তাদের কাছ থেকে আমাদের দেশের মানুষ নিজের ভাষা বানিয়ে নিয়েছে। সে যাই হোক আমাদের দেশে হারিকেনের কোন রং না থাকলেও চীনে এই লাল হারিকেনের একটা বিশেষ ঐতিহ্য আছে । নামটিকে রুপক হিসেবে ব্যবহার করে পরিচালক ঝাং ইযুমু ১৯৯১ সালে এক অসাধারণ সিনেমা বানিয়েছেন, যা দেখলে আপনার চোখ প্রশান্তি পাবে এবং মন অনেকক্ষন বেদনায় ভারাক্রান্ত থাকবে। একটি শিল্পের এর চাইতে বেশি আর কি পাবার আছে?

যদিও এসব কারনে আমি কোন সিনেমাকে মাস্টারপিস বলি না । যে সিনেমা দেখলে আমার সিনেমা বানাতে ইচ্ছে করে, যে সিনেমা দেখলে আমি অনেকক্ষন হয়ে বসে থাকি সেটাই আমার কাছে মাস্টারপিস সিনেমা, সেটাই আমার কাছে ভালো সিনেমা । রেইজ দ্যা রেড লন্ঠন তেমনি একটি ভালো সিনেমা ।

কি আছে এই সিনেমায় ? কেউ হয়ত বলবে তেমন কিছুই নাই, কেউ বলবে দারুণ কিছু দেখলাম সিনেমাটিতে । আমি দ্বিতীয় দলে । খুব সহজ গল্প । সহজ ভাবে বানানো । এজন্যই হয়ত এত ভালো । সহজ কথা যায়না বলা সহজে কিন্তু পরিচালক তার বানানো ৪র্থ সিনেমাতে সেই কথাকে মিথ্যে প্রমাণ করতে পেরেছেন বলেই তিনি সফল। টঙ্গ ঝংগুই এর উপন্যাস ওয়াইভস এন্ড কনকিউবাইন থেকে 

এই সিনেমার চিত্রনাট্য করেছেন নি ঝেন । শুরুতে সিনেমার গল্পটির দিকে একটু নজর দেয়া যাক ।

পটভুমি :

১৯২০ সালের দিকের ঘটনা এটি । চায়নায় তখন গৃহযুদ্ধের ডামাডোল । সংলিয়ান ১৯ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এক তরুনী। বাবা মারা যাওয়ার পর অনিচ্ছা সত্বেও সৎ মা এর চাপে বিয়ে করে বিশাল ধনী এবং বুড়ো মাস্টার চ্যানকে । পারিবারিকভাবে ধনী চ্যানের পরিবারে সংলিয়ান আসে চার নম্বর বউ হিসেবে । প্রথম বউয়ের একটি ছেলে সন্তান আছে যা তার সমবয়সী, দুই নম্বর বউ এর ছেলে সন্তান নাই বলে সে খুব দু:খী, তৃতীয় বউ একজন অপেরা শিল্পী এবং গৃহকর্তার খুবই পছন্দের । আছে প্রত্যেক বউয়ের জন্য আলাদা আলাদা চাকর বাকর এবং বিলাসী জীবনের সকল উপকরন ।

প্রথমে এসে এমন জীবনে কিছুটা আনন্দ পেলেও সংলিয়ান ধীরে ধীরে আবিস্কার করে এইসব সেবা যন্ত সব বউ এর জন্য সমান নয় এবং সবসময়ের জন্যও নয় । বাড়ির কর্তার মর্জির উপর এসব কিছু র্নিভর করে । যেদিন যার ঘরে কর্তা রাত্রি যাপন করবেন সেই স্ত্রী পাবেন বিশেষ সেবা যত্ন । তার ঘরের সামনেই জ্বলবে লাল লাল বাতি । আর মুনিবের এই মনোযোগ আকর্ষনের জন্য গোপনে বউদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে ।

এই প্রতিযোগিতায় জিততে তারা একেকজন একেক ধরনের অপরাধ করে বসে। পারিবারিক সম্পর্কের নোংরা রাজনীতে জড়িয়ে পড়ে সবাই । ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে প্রথা আর ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে চ্যান পরিবার কিভাবে নারীদের উপর অত্যাচার চালায় । কিভাবে বাড়ির বউরা নিজেরাও অন্যায়, অপরাধ আর মিথ্যাচারে জড়িয়ে যায়। পরকীয়ার শাস্তি হিসেবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয় তৃতীয় বউকে । যাতে পরিবারের সম্মান ক্ষুন না হয় সেজন্য আত্নহত্যা বলে চালানো হয় এই হত্যাকান্ড দেখে ফেলে সংলিয়ান । এই দেখে ফেলার অপরাধে তাকেও পাগল সাব্বস্ত করা হয় ।

এরপর ঠিক আগের মতোই মাস্টার চ্যান এর পঞ্চম বউ এর আগমন ঘটবে বাড়িতে। সিনেমাটি শেষ হয় সংলিয়ানের ছোট বেলার স্কুল ড্রেস পরে বাড়ির বাহিরে পাগলের মতো ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে দিয়ে ।

ব্যবচ্ছেদ :

কেউ কেউ বলে থাকেন এটি একটি পরিশুদ্ধ সিনেমা, অতিরিক্ত বা অপ্রযোজনীয় কিছুই নেই এই সিনেমাটি । সে যেমন গল্পে, তেমনি দৃশ্যায়নে তেমনি সঙ্গীতের ব্যবহারে । সিনেমা প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় সংলিয়ানের ক্লোজ আপ মুখ । প্রথম ডায়লগ হচ্ছে মা এবার থামেন, তিনদিন ধরে অনেক বলছেন, আমি বিয়েতে রাজি এর পর মা মেয়ের কথোপোকথন শেষে দেখব সংলিয়ানের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে । পর্দায় এক মিনিট ১৪ সেকন্ডের একটি মাত্র শট, একটি মাত্র মুখ। একশটে কতগুলো গল্প এবং দৃশ্য বলে দিলেন পরিচালক । ছবি দিয়ে যা বলা যায় তা আর কিছু দিয়ে বলা যায় না, এটাই শিল্প হিসেবে সিনেমার বড় শক্তি ।

এটি সরলরৈখিক পদ্ধতি বানানো যাকে সিনেমার ভাষায় যাকে বলে লিনিয়ার সিনেমা । এই পদ্ধতির সুবিধা হলো শুটিং এর সময়ই এডিটিং হয়ে যায়, পরে সম্পাদনার টেবিলে এসে শুধু একটি পর একটি শট জোড়া দিলেই সিনেমা বানানো শেষ । এর জন্য অবশ্য বিস্তর প্রি প্রোডাকশনের কাজ করতে হয় । এধরনের সিনেমায় চোখ দারুণ আরাম পায় । সিনেমা তো আসলে দেখারই জিনিষ । এই লিনিয়ার সিনেমাগুলো সেই দেখার জায়গাটাকে পোক্ত করে ।

সিনেমার প্রথম দিকে মনে হবে ২য় বউটা খুব ভালো , ৩য় বউ খারাপ, পরে গিয়ে মনে হবে ৩য়টা ভালো ২য়টা বেশ খারাপ । আসলে সবাই ঈর্ষা, বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসা নিয়ে একটি মরীচিকার পিছনে ছুটছে, আর সেটি হচ্ছে প্রধান কর্তার মনোযোগ আকর্ষন । যারা বাংলা অথবা হিন্দি সিনেমা দেখে অভ্যস্ত তাদের বারবার মনে হবে , নায়িকা এই বুঝি এমন মীরাকল বা অতিমানবীয় কিছুু করবে। ভিলেনকে মেরে কেটে এই বাড়ি নামক জেলখানার শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে যাবে । এই সিনেমায় তেমন কিছুই ঘটে না । না ঘটার কারন এটাই বাস্তব, এটাই নির্মম সত্য । হাজার বছর ধরেও এই শিকল নারীরা এখনও ছিঁড়তে পারেনি । কবে পারবে কেউ জানে না । সিনেমার দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রেও বাড়িটিকে দূর্গ অথবা একটি জেলখানার মতো করে দেখানো হয়েছে

ডায়লগ :

অসাধারণ কিছু ডায়লগ আছে সিনেমাটিতে । ৩য় বউ এর গান শুনে সংলিয়ান যখন প্রশংসা করে তখন উত্তরে সে বলে ভালো আর মন্দ দুটোই তো অভিনয় ,তুমি যদি ভালো অভিনয় করো তবে তুমি সবাইকে বোকা বানাতে পারো, যদি খারাপ অভিনয় করো তবে তুমি শুধু নিজেকে বোকা বানাতে পারো। তুমি যদি নিজেকেও বোকা বানাত না পারো, তবে তুমি ভুত বা আত্নাকে বোকা বানাতে পারবে । আত্নহত্যার ঘটনা এই বাড়িতে নতুন নয় এটা জানার পর সংলিয়ান একবার বলে যতগুলো মানুষ এখানে আছে তারা সবাই ইদুর বিড়ালের মতো , তারা মানুষ না।এটার চাইতে ভালো নয় ফাঁসিতে ঝুলে পড়া এক ডায়লগে বাড়ির ভিতরের করুণ অবস্থাটা বোঝা যায় ।

মেটাফর :

অনেকে এই সিনেমাটিকে চীনের সেসময়ের রাজনীতির রুপক হিসেবে বিবেচনা করে । বাড়ির প্রধান কর্তাকে তুলনা করে চীনের স্বৈরশাসক সরকারের সাথে, আর পরিবারের প্রথা আর ঐতহ্যিগুলোকে তুলনা করে দেশের আইন এর সাথে এবং সংলিয়নকে তুলনা করে দেশের নাগরিক, হিসেবে, যার নিজের ঘরে কোন অধিকার নাই ।

দেখা যায় বাড়ির প্রধানকর্তা ও কাজের মেয়ের এবং ৩য় স্ত্রীর সাথে পারিবারিক ডাক্তারের মধ্যে পরকীয়ার সম্পর্ক । এর জেরে দুটি মৃত্যু ঘটে এই সিনেমায়, দুটিই নারী। পুরুষদের কোন শাস্তি দেখা যান সিনেমায়।পরকীয়ার অপরাধে পুরুষের যেন কোন শাস্তি নেই । এটাই চীনের সেসময়ের সমাজ । আমাদের সমাজেও কি তেমনটি নয় ?

একটা অদ্ভূত খেলা চলে এখানে। বাড়ির কাজের মেয়ের মনে গোপন বাসনা সেও একদিন এই বাড়ির বউ হবে। সে জন্য নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে ফেলে, অথচ বাড়ির বউদেরই কোন অধিকার নাই, প্রশান্তি নাই, কোন জীবন নাই। একজন ভৃত্যের আরেকটু উচ্চতর ভৃত্য হবার জন্য কি প্রাণপণ চেষ্ঠা! এটাই কি এখনকার সমাজেরও দর্পণ নয়? এমনি এক গোলক ধাঁধায় আমারা সবাই কি দৌঁড়াচ্ছি না ? উপরে উঠার চেষ্ঠায় সবাই কি নিচে নেমে যাচ্ছি না ?

কয়েকটি ঋতুতে পুরো গল্পটি দেখানো হয়, ঋতুর পরিবর্তনগুলো ফুটে ওঠে বাড়ির ছাদে বৃষ্টি, বরফ আর শুকনো দেখানো মধ্য দিয়ে । পরিচালক নিজে একসময় ক্যামেরাম্যান ছিলেন তাই হয়ত চীনের স্থ্যপত্যকে এত সুন্দর করে তুলতে পেরেছেন। যদিও সিনেমায় প্রথম বোঝা যায় না এটা প্রাচীন চীন নাকি কিছুকাল আগের চীন । গ্রামোফোনের রেকর্ড না বাজালে ৪ /৫ শ বছর আগের কোন গল্প দেখছি বলে মনে হত ।

সংলিয়নের চরিত্রে অভিনয় করা গঙ লী এক কথায় অসাধারণ । তার সৌন্দর্য আর অভিনয় মুগ্ধ করার মতো । চীনের অনেকে মনে করেন এটা বিদেশীদের আকৃষ্ঠ করার সিনেমা। বিদেশীরা চীনকে এতটা রক্ষনশীলভাবে দেখতে চায় বলে এই সিনেমার এত প্রশংসা ।

শেষ অধ্যায় :

সিনেমাটি যে কয়েকটি বিশেষ ঘটনা নজর এড়াবেনা কারো । পুরো সিনেমায় বাড়ির প্রধান কর্তার চেহারা একবারো দেখায় না , দেখালেও দুর হতে দেখায় । এই না দেখানোয় তার চরিত্রের শক্তিটা বেশি প্রকাশ পেয়েছে । অদৃশ্য শক্তির মতো । চীনের বাড়ির দৃশ্যগুলো চিত্রিত হয়েছে অসাধারনভারে । গোলাপী ও লাল রং এর ব্যবহার সিনেমাটি দারুন রঙিন করে তুলেছে ।

পুরো সিনেমায় ৩/৪ টি শটে শুধু ক্যামেরার নড়াচড়া দেখি বাকি সব দৃশ্যে ক্যামেরাকে স্থির থাকতে দেখি, এটা চোখকে দারুণ আরাম দেয়। সঙ্গীতের ব্যবহার অসাধারণ, লাল বাতিগুলো আসলেই একটি বিশেষ সুর বেজে ওঠে । শুধু শব্দ দিয়েও যে অনেক কথা বলা যায় সেটা এই সিনেমায় স্পষ্ট । যেমন সংলিয়ানের পা ধোয়ার সময় আরেক ঘর থেকে পা ম্যাসাজের ঝুনঝুন শব্দ আসে, এটা একটা বিশেষ সুর দেয় দর্শকের মনে । সিনেমা একটিও কোন চুমুর বা শয্যার দৃশ্য নাই অথচ সিনেমাটি সেক্সুয়ালিটি, পরকীয়া এসবের গল্প । 

এই না দেখানোর মধ্যেই পরিচালকের মুন্সিয়ানা । জয় হোক ভালো সিনেমার ।


শিল্পিত পারু
লেখক ও সাংবাদিক