অঞ্জন আচর্য ।।
বাজি ধরে বলতে পারি, বাংলাদেশের ৯৫% পাঠক নোংথোম্বর কুঞ্জমোহন সিংহের নাম শুনেনি। আর ৯৯% পাঠক তাঁর কোনো লেখাই পড়েনি। নাম-গল্পটি কারো কারো হয়তো পড়া থাকতে পারে। কারণ ইলিশ-প্রিয় বাঙালিদের কাছে সেটি কৌতূহল-উদ্দীপক। যদিও গল্পটি চূড়ান্ত অর্থে ইলিশ মাছের নয়, এক নিম্নবিত্ত জেলের বঞ্চিতের আখ্যান।
সম্প্রতি বইটি শেষ করলাম। আর পড়ে বার বার ধাক্কা খেলাম। এভাবেও গল্প লেখা সম্ভব! কত ছোট্ট পরিসরে কত বৃহত্তর পরিমণ্ডলকে ধরা যায়, তা নোংথোম্বরের গল্পপাঠে উপলব্ধি করলাম। ছোটগল্প আমার প্রতিনিয়ত পড়া হয়। প্রতিবারই পড়ার আগে ভাবি, ইশ! আজ যদি ভেতর থেকে ঝাঁকুনি দেওয়া একটা গল্প পড়তে পারতাম! কখনও এমন ঝাঁকি খেয়েছি বৈকি। তবে অধিকাংশ সময়ই থেকেছি নির্লিপ্ত, কোনো অনুভূতিই কাজ করেনি। বহুদিন পর নোংথোম্বরের গল্প আমাকে সেই ঝাঁকুনি দিয়েছে। কেবল ঝাঁকুনি বলবো কেন, রীতিমতো ৮ মাত্রার ভূমিকম্প দিয়ে গেছে! অনুবাদের গুণও এখানে উল্লেখ না-করলেই নয়। এত বোধগম্য প্রাঞ্জল অনুবাদ খুব একটা চোখে পড়ে না।
আমরা যারা অল্প-বিস্তর গল্প লেখার চেষ্টা করি কিংবা ইতোমধ্যে গল্প-লিখিয়ের খাতায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছি, তাদের বলবো একবার অন্তত এই বইটি পড়তে। ব্যক্তিগত ভালো-লাগা, মন্দ-লাগা থেকে বলছি না— বরং নিজের দীর্ঘদিনের পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। পড়ার পর কথাটি মিলিয়ে নিয়েন।
লাতিন, আফ্রিকান, ফ্রাঞ্চ, জার্মানসহ বহু বিদেশি সাহিত্য তো হলো। গল্পের নামে অনেক নিরীক্ষাও দেখা হলো। তবে দিনশেষে পাঠক ভালো গল্প পড়তে চায়। তরল নয়, সরলভাবে গল্প শুনতে চায়। ভাষার মারপ্যাঁচ দিয়ে অযথা জটিল করা নয়, কিংবা চুইংগামের মতো টেনে টেনে অকারণ লম্বা করা নয়— পরিমিতি বোধই গল্পের প্রাণ, যা খুব ভালো করে জানেন নোংথোম্বর। আর জানেন বলেই, যেখানে ইতি টানতে হয়, সেখানেই সমাপ্ত ঘটিয়েছেন তিনি। তবে, তারপরেও কথা থাকে। শেষে এসে এমন এক জায়গায় প্রতিটি গল্প শেষ করেছেন, যেখান থেকে শুরু হয়েছে নতুন গল্পের। ওই গল্প লিখবেন প্রতিটি পাঠক তার নিজের মতো করে। কথাটি বিশ্বাস না-হলে নিজেই যাচাই করে দুই-এক কথা শুনিয়ে দিয়েন।
রবীন্দ্রনাথের সেই বহুল পঠিত লাইনটি আজ বার বার মনে পড়ছে : “বহুদিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে/দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শীষের উপরে, একটি শিশির বিন্দু।” নোংথোম্বর কুঞ্জমোহন সিংহ হলেন সেই শিশির বিন্দুর নাম। পাশের দেশের মণিপুর রাজ্যে যাঁর বাস।
মণিপুরী এই লেখক আজও বেঁচে আছেন কিনা জানা নেই। তবে তাঁর সন্ধান পেলে পায়ের ধুলো নিয়ে আসতাম। গল্প কী করে লিখতে হয় আপনি দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমার সেই মেধা বা যোগ্যতা কোথায়, আপনার মতো করে একটি, মাত্র একটি গল্প লেখার?
লেখকের ফেসবুক থেকে
0 Comments