খন্দকার মো. মাহমুদুল হাসান ।।
ইহুদি
বিদ্বেষ (Anti-semitism ) মূলত ক্রিশ্চিয়ান রোগ। দুই হাজার বছরের পুরনো রোগ।
ইহুদিরা যিশুকে ঈশ্বর পুত্র বলে স্বীকার করতো না এবং নবী বলেও স্বীকার করতো না।
আবার ক্রিশ্চিয়ানরা ভাবতো যিশুর মৃত্যুর জন্য ইহুদিরা দায়ী। যিশুর মৃত্যুর পর
ইহুদিরা নিজেদের বিশেষায়িত করে দেখা শুরু করে।
কিন্তু কিছুদিন পর ক্রিশ্চিয়ান ধর্ম রোমান
রাজদরবারে ঢুকে পড়লে বিপাকে পড়ে ইসরায়েল পুত্ররা, জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত হয়।
যিশু খ্রিস্টের মৃত্যুর পর থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার বছর
ক্রিশ্চিয়ানরা শত শত, হাজার হাজার, লাখ লাখ ইহুদি হত্যা করেছে। জেরুজালেম থেকে
বার বার ইহুদিদের বিতাড়িত করেছে ক্রিশ্চিয়ানরা। নির্বাসিত ইহুদিদের অন্য কোন
ক্রিশ্চিয়ান রাজ্যে আশ্রয় মিললেও তারা বাধ্যতামূলকভাবে সমাজের হরিজন হিসাবে চলতে
বাধ্য হত। ক্রিশ্চিয়ানরা ইহুদিদের শুধু হরিজন হিসাবে দেখলেও কোন সমস্যা হত না।
শুটাররা যেমন টার্গেট প্র্যাকটিস করে, ক্রিশ্চিয়ানরা তেমনি ইহুদি কিলিং
প্র্যাকটিস করতো।
ক্রিশ্চিয়ান
রাজ্যের যেখানেই ইহুদি কলোনি গড়ে উঠেছে, সেখানেই ব্যাপক আকারে গণহত্যা চলেছে,
ধর্ষণ চলেছে, জোর করে ধর্মান্তরিতকরণ চলেছে। ইহুদি গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ
ক্রিশ্চিয়ান সমাজে যেন একটা অনুমোদিত ব্যাপার ছিল। তারা ইহুদিদের ঈশ্বরের
পরিত্যক্ত জাতি মনে করতো এবং ভাবতো ইহুদি হত্যা পাপ নয়। ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ
করার পর ইহুদিরা স্বস্তি পায়। গণহত্যা থেকে যেসব ইহুদি বেঁচে ফিরতো তারা ও
বিতাড়িত ইহুদিরা মুসলিম রাজ্যগুলিতে আশ্রয় নেওয়া শুরু করলো। যেহেতু কোরআন শরীফে
মুসা ও ইসার অনুসারীদের কথা উল্লেখ রয়েছে, তাই হয়তো মুসলিমদের এদের প্রতি আলাদা
সহমর্মিতা কাজ করতো।
মুসলিম রাজ্যগুলিতে
ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের গণহত্যার খবর খুবই নগণ্য; ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্ম
কর্ম ও রীতিনীতি পালন করতে পারতো। তারা রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারতো
এমনকি রাষ্ট্রীয় পদে চাকুরি পেত। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের একটাই বড় সমস্যা ছিল, তা
হলো এদের আলাদা কর দিতে হত। তবে শিশু, বৃদ্ধ ও সম্ভবত মহিলাদের কর দিতে হত না।
মুসলিম স্পেন ইহুদিদের জন্য একটা স্বর্ণযুগ ছিল। বর্তমান সময়ের আগে ও ইহুদি
সাম্রাজ্যের পরে একমাত্র মুসলিম স্পেনেই ইহুদিরা সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছিল।
স্পেন আবারও ক্রিশ্চিয়ানদের দখলে যাওয়ার পর ইহুদি ও মুসলিম গণহত্যা চালানো হয়।
তখন ইসরায়েল তুরস্ক সাম্রাজ্যের অধীনে। গণহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা ও বিতাড়িত
ইহুদিদের তুর্কিরা জেরুজালেমে এসে বসবাস করতে আহ্বান জানায়।
আর এদিকে ইসরায়েল
যতবার ক্রিশ্চিয়ানরা দখল করেছে ততবার ইহুদিরা হরিজনের জীবনযাপন করেছে, অথবা
বিতাড়িত হয়েছে অথবা ক্রিশ্চিয়ানদের হাতে নিহত হয়েছে। ইসরায়েলে ইহুদিরা মাথা
উঁচু করে চলতো শুধু যখন মুসলিমরা ইসরায়েল দখল করেছে।
মুসলিম রাজ্যগুলিতে যে
একেবারেই ইহুদি হত্যা/গণহত্যা হত না তা নয়। কিন্তু কম্পাংকের কথা চিন্তা করলে তা
দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ে, যা ক্রিশ্চিয়ান রাজ্যগুলিতে প্রায় প্রথাগত ব্যাপার ছিল।
পূর্ব আধুনিক যুগ ও
আধুনিক যুগের শুরুতে ক্রিশ্চিয়ানদের সংগে মুসলিমদের সামাজিক রীতিনীতির বিনিময়
শুরু হয়। এই বিনিময়ে ইহুদি বিদ্বেষ ক্রিশ্চিয়ান থেকে মুসলিমদের ভেতরে চলে আসে।
ইহুদি বিদ্বেষ মুসলিমদের ভেতরে চরম আকার ধারন করে, যখন জাতিসংঘ প্যালেসটাইন
পার্টিশন ঘোষণা করে। এরকম কোন ব্যাপার ছিল না যে আরবরা ইহুদিদের কাছে থেকে
প্যালেসটাইন দখল করে নিয়েছে, তাই জাতিসংঘ ইচ্ছা প্রকাশ করেছে যে প্যালেসটাইন
ইহুদিদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। বরং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশরা তুরস্ক
সাম্রাজ্যের কাছে থেকে প্যালেসটাইন দখল করে নেয়। অতএব আইন অনুসারে ব্রিটিশকে
প্যালেসটাইন আরবদের কাছে ফেরত দেওয়ার কথা ছিল।
চার হাজার বছর আগের ওল্ড টেস্টামেন্টের
ম্যান্ডেট এবার ব্রিটিশ ম্যান্ডেট হয়ে নাজিল হয়। যে ধর্মগ্রন্থ (সমুহ) যিশুকে
স্বীকার করে না, সেই ধর্মগ্রন্থের ম্যান্ডেটকে বাস্তবায়িত করলো ব্রিটিশ
ক্রিশ্চিয়ানরা; উদ্দেশ্য আরব অঞ্চলগুলোতে যুদ্ধ পরবর্তী নিয়ন্ত্রণ। যখন জাতিসংঘ
পার্টিশন প্ল্যান প্রকাশ করে তখন ফিলিস্তিনে ইহুদিদের মাত্র 7% ভূমি ছিল, কিন্তু
প্ল্যানে তাদেরকে 56% ভূমি দেওয়া হয় আর যাদের ছিল 93% তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়
অর্ধেকেরও কম। যা হবার তাই হল: আরবরা মেনে নিল না, জায়নবাদিরা খুশিতে আত্মহারা।
ফিলিস্তিনিরা যদি সেই অদ্ভুত ম্যান্ডেট সেদিন মেনে নিত, তাহলে আজ স্বাধীন রাষ্ট্র
হিসাবে থাকতো। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মানার কোন কারন ছিল না। কারন 2500 বছর আগে
ইহুদিরা ফিলিস্তিন ত্যাগ করে, মাঝখানে অল্পকিছু সময়ের জন্য স্বাধীন রাজ্য গড়ে
তোলা ছাড়া আর কখনই তারা ইসরায়েলে স্থায়ীভাবে বসবাস করেনি বা করতে পারেনি ;
ক্রুসেড
শেষ হলে তাদের ফেরার সুযোগ ছিল, তুরস্ক সাম্রাজ্যের আমলে ফিরতে পারতো। ফেরেনি।
ইতিহাসের এত স্বল্পকালীন সময়ে বসবাসকারিদের কোন এলাকার অধিবাসী বলা যায় না।
ফিলিস্তিনে ফিলিস্তিনি আরব ও ইহুদিরা প্রায় সমসাময়িক। ফিলিস্তিনি আরবরা যে
হত্যার সম্মুখীন হয়নি তা নয়; কিন্তু তারা ফিলিস্তিন অঞ্চল ত্যাগ করেনি।
যৌক্তিকতা থেকে
সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন আসে না, আসে ক্ষমতা থেকে। ব্রিটিশ প্রশাসন চলে যাওয়ার পর
আরবরা ভাবছিল ইহুদিদের বিদায় করতে পারবে। ফিলিস্তিনিদের সাহায্যে এগিয়ে আসে
কতকগুলো আরব রাষ্ট্র, ভেতরে দুরভিসন্ধি: যুদ্ধের পর ফিলিস্তিন নিজেদের করে নেওয়া।
প্রত্যেকেই সাহায্যের নামে ধান্দাবাজি করতে আসে। একজন তো ইহুদিদের সংগে গোপন আঁতাত
করে। বার্তা বিনিময় ছিল না, পরিকল্পনা ছিলনা, ছিল ধান্দাবাজি। যা হবার ছিল তার
চেয়েও খারাপ হল। ইহুদিরা আরো জায়গা দখল করে নিল। ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্র হারালো,
ইহুদিরা রাষ্ট্র পেল।
কতদিন টিকবে এই
ইসরায়েল রাষ্ট্র? এই চিন্তা মহাত্মা গান্ধীর। জায়নবাদিদের পদ্ধতিগত ভুল এখানেই।
তারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে ইউরোপীয়দের সাহায্যে, কিন্তু বাস করছে আরবদের
প্রতিবেশী হয়ে। জায়নবাদিরা যদি তাদের রাষ্ট্র চিন্তার কথা আরবদের কাছে পেশ করতো,
তুরস্কের কাছে পেশ করতো, তাহলে হয়তো আজ ক্ষমতার জোড়ে টিকে থাকার প্রশ্ন উঠতো না।
কারণ তখন আরবরা ইহুদি বিদ্বেষী হয়ে উঠলেও ক্রিশ্চিয়ানদের মত ইহুদি হত্যাকারী
হয়ে উঠেছিল না: পুরনো সহমর্মিতা তখনও ছিল। আরবদের অনুরোধ না করে, তাদেরকে আঘাত
করে যে রাষ্ট্র জায়নবাদিরা তৈরি করেছে, তা টিকিয়ে রাখতে ইহুদিদের সবসময় ক্ষমতার
তুলনামূলক বিচারে এগিয়ে থাকতে হবে। যদি কখনও আরবরা ক্ষমতার তুলনামূলক বিচারে
এগিয়ে যায় তাহলে হয়ত ইহুদিদের আবারও বিতাড়িত হতে হবে, তবে এবার নতুন হাতে।
সহকারী অধ্যাপক , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফেসবুক থেকে
0 Comments