শাওন মাহমুদ।।
বয়স যখন পঞ্চাশ পার হয়ে আরো বাড়তে থাকে তখন নিজের খেয়াল নিজেকে নেয়ার অভ্যাস আরো বাড়াতে হয়। স্বাভাবিক সময়ে হঠাৎ ঘেমে ওঠা, প্রচন্ড গরমে শীত লাগা, ওজন বেড়ে যাওয়া, মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকা, মুখ চোখ লাল হয়ে আসা, কোন কারণ ছাড়াই বিষন্নতায় বুক ফেটে হাহাকার করে কাঁদার মতন অদ্ভুত সব বিষয়গুলো খুব করে নিজেকেই খেয়ালে আনতে হবে।
জানার অভাবে হোক বা না জানতে চাওয়ার অভাবে হোক, এই বয়সী নারীদের কেউ বুঝতে পারে না বা বুঝবার চেষ্টা করে না। হাই প্রেশার, ডায়েবেটিক, অতিরিক্ত কোলেস্টরেল, হৃদরোগ বা মানসিক রোগীর কাতারে ফেলতে থাকে আশপাশের সবাই। এবং তাদের প্রতি আরো বেশী করে বেখেয়াল হতে থাকে। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত উপেক্ষায় এই বয়সী নারীরা তখন পরিবারের কাছে নিজেদের শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে অযোগ্য, শক্তিহীন এবং সামর্থ্যহীন ভাবতে শুরু করে। একসময় সবার থেকে অনেক দূরে নিজের অবস্থান তৈরী করে নেয়। একই বাসায় থেকেও তারা নিজের মতন জীবন যাপন শুরু করে। নিরানব্বই শতাংশ পরিবারের মানুষ তাদের এই অদ্ভুত একলা হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলতে চায় না বা হিসেবেই ধরে না।
নারী জীবনের সবচেয়ে একা হয়ে যাওয়া সময়, এই পঞ্চাশ বছরের সময়। এসময়ে তার শারীরিক ও মানসিক বিষয়গুলো তাকেই হাল ধরতে হবে। আমাদের দেশে ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কথা বলবার জন্য কোন কাউন্সেলিং সেন্টার নেই। স্বাভাবিক হলেও হঠাৎ বদলে যাওয়া শারীরিক সমস্যা নিয়ে কথা বলবার জন্য মা, খালা থাকলেও, তাদের কাছে অনেক কথাই বলা হয়ে ওঠে না। সমস্যাগুলো চাপা পরতে থাকে, ভার বাড়তে থাকে মনে, শরীরে। বয়সের আগে বয়স বাড়তে থাকে। মুখের চামড়া কুঁচকে আসে, নখ খড়খরে হতে থাকে, কেশ ঘনত্ব হারাতে থাকে। মুখ দেখানোর অযোগ্য মনে হতে থাকে নিজেকে।
নারীদের মেনোপজ হবার পর জরায়ুর মুখে বা জরায়ু ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী থাকে। পঞ্চাশ বছর পার হওয়া শতকরা পচানব্বই ভাগ নারী মেনোপজকে নিজেদের জীবন শেষ বলে মেনে থাকে। তখন তারা সন্তান, নাতিনাতনীর দিকে পুরোপুরি মন, ধ্যান জ্ঞান অর্পণ করে থাকে। হালকা তলপেটের ব্যাথা, হালকা স্পটিং, মাথা ঘুড়ে ওঠা, সন্ধ্যায় জ্বর আসা, বারবার সর্দি কাশি, মাথা ধরে থাকা বা ক্লান্ত হওয়াটাকে বয়স হয়েছে বলে তেমন খেয়াল করে না কেউ।
অথচ এই সমস্যাগুলো একটু মাথায় নিলে সময় মতন জরায়ু সম্পর্কিত সব ধরনের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় খুব সহজেই। দুই বছর পরপর প্যাপস্মেয়ার টেস্টটা আমরা নারীরা কেউ করি না অথবা আমাদের কেউ বলেও না করতে। আঠারো বছর পার হবার পর নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক এই টেস্ট সম্পর্কে আমরা কেউ সচেতন নই। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি কমিউনিটি সার্ভিস থেকে আঠারো পার হওয়া প্রতিটা নারীকে দুই বছর পার হবার তারিখ আসবার আগেই কল করে মনে করিয়ে দেয়া হয়, পেপস্মেয়ার করবার সময় এসেছে। এবং এলাকার জিপি খুব সহজেই টেস্টটি করে রিপোর্ট দিয়ে থাকে। সমস্যা হলে স্পেসালিস্টের কাছে রেফার করে তারা।
যাক সেসব কথা। আসল কথায় আসি। গত একমাস ধরে আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি ভালো নেই। গত সপ্তায় ডাক্তারকে সমস্যাগুলো জানাতেই তিনি সনোগ্রাম করতে বলেন। রিপোর্ট আসবার পর এমআরআই করবার জন্য সাজেস্ট করেন তিনি। গতকাল এমআরআই করে এসেছি। আজ দুপুরে রিপোর্ট দিবে। এরপর আর যা যা করবার তা মিল্টন ভাই এবং ডাক্তারই বলে দিবেন। তাঁদের সব কথা বাধ্য হয়ে শুনবার এবং করবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি।
সাড়ে একান্ন বছরে এমন কিছু হবার কথা, হতেই পারে বলে মন বলছিল খুব। গুগল করে এই সমস্যায় কি হতে পারে আর না হতে পারে তার সবটুকু পড়ে ফেলেছি। তবে মেডিকেল টার্মগুলোর অনেক কিছু বুঝি নাই। তারপরও বিশ্বাস রাখছি, আমার কিছুই হয়নি। মানুষ মাত্রই অসুখ হয়। সময় মতন সচেতন হলে সব অসুখ থেকেই মুক্তি পাওয়া যায়। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব সময় মতন সচেতন হওয়ার, আমি হয়েছি।
টিপু আমাকে সবসময় বুঝবার চেষ্টা করে। বিশেষ করে পঞ্চাশ পার হবার সময় থেকে আমার প্রতিটা শারীরিক এবং মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলে। তাতে মন হালকা থাকে, একলা লাগে না একদম। পঞ্চাশে থাকা নারীদের কথা শুনতে হবে, আপনার অনেক অনেক বিরক্ত লাগলেও। উপেক্ষা করে তাদের শারীরিক অসহায়ত্বকে নড়বড়ে করা যাবে না একদমই। এই বয়সী নারীদের জীবনসঙ্গী, সন্তান, বন্ধু বা সহকর্মীদের প্রতি অনেক বেশী মনোযোগী হবার এবং ধৈর্য্য রাখবার অনুরোধ রইলো। একটু পাশে থাকলে, মেনে নিলে, সময় দিলে কারো কোন ক্ষতি হয় না জানি। এই অস্বাভাবিক সময়গুলোতে তারা কাছ থেকে সহযোগীতা পেলে, নিজের সাথে সাময়িক লড়াইটা থামতে সময় নিবে অনেক অনেক কম।
সবাই ভালো থাকুক। সুস্থ থাকুন।
ভালোবাসা।
শাওন মাহমুদ
ফেসবুক থ
0 Comments