রুমেল এম.এস. পীর ।।
মহাত্মা গান্ধী ছিলেন জাঁদরেল আইনজীবী। বিলেতে আইন বিষয়ে পড়ালেখা শেষ
করে কাজও করেছেন বৃটিশ কোর্টে। পরে তিনি প্র্যাকটিস করতেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, ‘দাদা আব্দুল্লা
এন্ড সন্স’ নামের একটি কোম্পানীর পক্ষে। তিনি
স্যুট-টাই পরে একটি কাজে ট্রেনে প্রথম শ্রেণীর কামরায় যাচ্ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় তখন
কালো ও ভারতীয়দের ঘৃণার চোখে দেখা হতো। যেহেতু তখন অখন্ড ভারত ছিলো তাই ভারতীয় বলতে
বাংলাদেশী, পাকিস্তানী ও হিন্দুস্তানী- সবাইকে বুঝানো হতো। তো সেই শীতের রাতে একজন
শ্বেতাঙ্গ অনেকটা ধাক্কা দিয়ে গান্ধীকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিলো। বললো ‘কালো লোকের প্রথম শ্রেণীর কামরায় বসাটা
মানায়না’। ঐ শ্বেতাঙ্গের নাম জানিনা আমি
তবে তাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কারণ, তার এমন বর্ণবাদী আচরণের জন্যেই পরবর্তীতে ভারতীয়
উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মোড় ঘুরে গিয়েছিলো। আমরা পেয়েছিলাম একজন মাহাত্মা-
যার অর্থ মহান আত্মা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্মান করে তাকে প্রথম ডেকেছিলেন ‘মহাত্মা’।
ঐ ঘটনার পর অনেকদিন পর্যন্ত গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকাতেই ছিলেন। সেখানে
ভারতীয়দের সম্মান আদায়ের সংগ্রাম করে গেছেন তিনি। জেল খেটেছেন সেখানেও। তবু তার রাস্তা
পরিবর্তন করেননি। দীর্ঘ অসহিংস আন্দোলন ও নির্যাতন সইবার পর দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা মানুষেরাও
এই কালো ভারতীয়দের প্রতি সহানুভুতিশীল হয়ে উঠে। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার সেই দেশে অবস্থানরত
ভারতীয়দের জন্যে তৈরি করা সকল অসম্মানজনক আইন বাতিল করতে বাধ্য হয়।
১৯১৫ সালে মাহাত্মা গান্ধী ফিরে আসেন নিজের দেশে। তখন তার বয়স প্রায়
৪৫। যুক্ত হোন ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। তার আন্দোলনের মূলকথাই ছিলো ‘শান্তি’। ‘মার খাবো তবু
পাল্টা মারবোনা’- এমন আন্দোলন শুরুতে অনেকেই মনে
করেছিলেন হাস্যকর। তিনি বলেছিলেন তারা মারতে মারতে একদিন ক্লান্ত হবে এবং আমাদের কথা
শুনবে, স্বাধীনতা আমাদের আসবে। নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু সহ অনেকেই এমন অসহিংস আন্দোলনের
বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু গান্ধীজী ছিলেন অবিচল। তিনি শুরু করলেন ‘স্বদেশী আন্দোলন’। ইংরেজের কাপড়, লবণসহ সব পন্য বর্জন করলেন।
সবাইকে ডাক দিলেন ইংরেজের চাকুরী ছেড়ে দেবার, ইংরেজের দেওয়া পদবী ছেড়ে দেবার। তিনি
মহিলাদেরকেও আন্দোলনে যুক্ত করলেন যা সেই সমাজে ছিলো অকল্পনীয়। প্রায় ১০০ বছর আগের
ঘটনা এসব! সত্যিই সাংঘাতিক।
তৎকালীন ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিমের বিভেদ ছিলো মারাত্মক। ইংরেজরাই দাঙ্গা
লাগাতো। ‘ডিভাইড এন্ড রুল’- এই ছিলো তাদের
পলিসি। গান্ধী বারবার থামিয়েছেন এসব দাঙ্গা। এর পাশাপাশি জাত প্রথার বিরুদ্ধেও তিনি
কঠোর ছিলেন। তিনি অনশন করেছেন বারবার, জেল খেটেছেন অনেকবার। ইংরেজরা তাকে দমাতে পারেনি।
পুরো ভারতবর্ষে তিনি তখন এক অবিসংবাদিত নেতা, সবাই ডাকে বাপুজী।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো। অনেক চেষ্টা করেও গান্ধীজী অবিভক্ত
ভারতবর্ষ রাখতে পারেননি। দুই ভাগ হয়ে এর নাম হলো ভারত আর পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর
কোনো রাষ্ট্রীয় পদ নিজের কাছে রাখেননি তিনি। ভীষণ সাদা-মাটা জীবনই ছিলো তার পছন্দ।
অথচ দূর্ভাগ্য, ১৯৪৮ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে এক উগ্রপন্থীর গুলিতে তাকে নিহত হতে হয়
আজকের দিনে, ৩০ জানুয়ারি। তার বয়স হয়েছিলো ৭৮ বছর। তার হত্যাকারী ছিলো এক উগ্রবাদী
হিন্দু, নাম নথুরাম গডসে। দেশ গড়ার কাজে হিন্দু-মুসলিম যে ঐক্যের ডাক দিতেন মহাত্মা
গান্ধী, জাত প্রথা মানতেন না- এর কারনেই রাগ ছিলো নথুরামের।
চিরদিন শান্তির জন্যে সংগ্রাম করা মাহাত্মা গান্ধীকে নোবেল শান্তি পুরস্কার
দেওয়া হয়নি, যদিও পাঁচবার তাকে নমিনেশন দেওয়া হয়! কি সাংঘাতিক অন্যায়। তবে এতে মহাত্মা
গান্ধীর সম্মান এতটুকু কমেনি। সত্যি বলতে, যদি গান্ধীজী নোবেল পুরস্কার পেতেন তবে তিনি
যতোটা সম্মানিত হতেন তার চাইতে ঐ পদকটাই সম্মানিত হতো বেশী। যে বৃটিশদের বিরুদ্ধে তিনি
আজীবন লড়াই করেছেন তারা অবশ্য তাকে সম্মান জানাতে ভুলেনি। তার মৃত্যুর ২১ বছর পর বৃটেনে
বিশেষ ডাকটিকেট ইস্যু করা হয়েছে গান্ধীর ছবি দিয়ে।
একটা কাকতালীয় ব্যাপার আছে, গান্ধীজী জন্মেছিলেন শুক্রবারে, মৃত্যুবরণ
করেছিলেন শুক্রবারে আর ভারত স্বাধীনতাও পেয়েছিলো শুক্রবারে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে
তার প্রয়াণদিবসে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে। শান্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য,
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যিনি দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন সেই ভারতে
আজ মুসলমানেরা চরমভাবে নির্যাতিত ও অপমানিত। আমি নিশ্চিত, গান্ধীজী বেঁচে থাকলে আজ
আবার অনশনে বসতেন তবু কোনো অন্যায়ের সাথে আপোস করতেননা। হাজার বছর বেঁচে থাকুক শান্তির
জন্যে সংগ্রাম, যুগ যুগ ধরে মানুষ অহিংস থাকুক, নিজের ধর্মটাকে পালন করুক আর অন্যের
ধর্মবিশ্বাসকে অমর্যাদা না করুক- এই হোক আজকের প্রার্থনা।
রুমেল এম.এস পীর
লেখকের ফেসবুক থেকে
0 Comments