প্রিয়া সেন ।।
কে আদপে কি? কার উত্তরাধিকার কে বহন করে? ইতিহাস বড় অদ্ভুত, যা আদপে আমরা
ভাবতেও পারি না।
প্রেমজিভাই মেঘজিভাই ঠক্কর।
গুজরাটি। কট্টর হিন্দু। নিরামিষভোজী। তিনি ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নার ঠাকুরদা।হ্যাঁ ওই বাবার বাবা।
প্রেমজিভাইয়ের ছিল মাছের ব্যবসা।
আত্মীয় - স্বজন, পাড়া - পড়শী সবাই এই ব্যবসার
কারণে তাঁকে "একঘরে" করে রেখেছিল। সে আমলে হত এমন কান্ড। ছোট ছোট
ব্যাপারে গ্রামের কারো কারো ধোপা, নাপিত বন্ধ হয়ে
যেত। নিরামিষাশী মানুষ মাছের ব্যবসা করবে এটা কেউই ভালো চোখে দেখেনি। তিনি মাছের
ব্যবসা বন্ধ করে দিলেন, তবু বাকিরা
তাঁকে অচ্ছুৎ করে রেখে দিলেন। খুব রাগ হল তাঁর। রাতারাতি সপরিবারে তিনি চার ছেলেকে
নিয়ে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করলেন। এ গেল গোড়ার ইতিহাস।
তবে এ গল্প দিনা জিন্নার।
ভারতভূমিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা
এক রমণীর কথা।
মহম্মদ আলী জিন্নার একমাত্র কন্যা, একমাত্র সন্তান, একমাত্র উত্তরাধিকারী। ১৯১৯ সালের ১৫ই আগস্ট লন্ডনে জন্ম। তাঁর ভারতভূমির
প্রতি কোন টান থাকারই কথা নয়। বাবা পাকিস্তানের সর্বেসর্বা হতে চলেছেন। তখন ১৯৪৩।
স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর ছেলে নাসলি কে নিয়ে একা। অর্থনৈতিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত। ওপারে অর্থাৎ পাকিস্তানে যাওয়া
মাত্র পাওয়ার, পজিশন, মানি সবই তাঁর আয়ত্তে আসবে। কিন্তু তিনি যাননি। প্রিয় শহর
বম্বে ছেড়ে তিনি নড়েননি।
১৯৩৮ সালে পার্সি ছেলে পছন্দ করেন
দিনা। নাম নেভিল ওয়াদিয়া। জিন্না বেঁকে বসেন। এ বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না। মুসলিম
কন্যার সাথে পার্সি বিয়ে ? অসম্ভব। মেয়ের
বিয়েতে আশীর্বাদ করতে আসেননি জিন্না। ড্রাইভার আব্দুল হাইয়ের হাত দিয়ে ফুলের বোকে
পাঠিয়ে কাজ সারেন। অল্পবয়সে মাতৃহারা এই কন্যাটিই সব ছিল জিন্নার।
তবু বাপের লাডলি স্বাধীনতার
প্রাক্কালে পিতাকে জানিয়ে দেন অমোঘ দৃঢ় স্বর। তিনি ভারতেই থাকছেন। তাঁর বাবা তখন
শেষ চেষ্টা করেন, লাহোর, করাচি সম্বলিত মুসলিমদের জন্য এক স্বপ্নের দেশের মায়াকাজল
পরানোর চেষ্টা করেন... দিনা বলেন, " তুমি কি
বম্বে থেকে আমার মায়ের কবর নিয়ে যেতে পারছ পাকিস্তানে?" ....
"Bombay is my city, আমার শহরের নাম
বম্বে।" শেষ কথা বাবার সাথে।
আক্ষরিক অর্থেই ভগ্ন হৃদয়ে পিতাকে
বিদায় দেন। তিনি পার্টিশনের পর আর দেখতে যাননি কেমন হল সেই দেশ, তাঁর বাবার স্বপ্নের পার্টিশন, স্বপ্নের পাকিস্তান। গেছিলেন তার পরের বছর ৪৮ এ। বাবাকে
শেষবিদায় জানাতে। জিন্নার শেষকৃত্যে।
একদিনের জন্য গিয়েছিলেন। পিতার
পাকিস্তানের বিপুল সম্পত্তির কণামাত্র দাবি করেননি। ফেরত আসেন বোম্বেতে।
১৯৪৬ এ দেখা হয়েছিল দু বছরের
নাসলির সাথে তাঁর দাদু জিন্নার। নিজের মাথার একটা ছাই রঙের টুপি পরিয়ে দিয়েছিলেন
নাতির মাথায়। জিন্না তাঁর ডায়রিতে লিখেছেন এটি তাঁর জীবনের খুব স্পেশাল একটা দিন।
৪৭ সালে দিনার ছেলে নাসলি মাত্র
তিন বছরের। তবু বম্বেতেই মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন দিনা ওয়াদিয়া। বিচ্ছেদ হলেও জিন্না
পদবীতে আর ফেরত আসেননি। সারাজীবন রয়ে গেছিলেন ওয়াদিয়া হয়ে। অনমনীয় জেদ আর অধ্যবসায়
সম্বল করে ব্যবসায় গতি আনলেন, এমন মানুষ করলেন
ছেলেকে,
আজও ভারতের ধনীদের তালিকায় প্রথম দশে জ্বলজ্বল করে নাসলি
ওয়াদিয়ার নাম। দিনা ওয়াদিয়া চুপচাপ অন্তরালে থাকলেন। নাসলি ওয়াদিয়া মহম্মদ আলী
জিন্নার একমাত্র ওয়ারিশ। আমাদের ভারতবর্ষের গর্ব।
মূলত বম্বে ডাইং এর মালিক তাঁরা।
আরো অনেক ব্যবসা আছে। নাসলির দুই ছেলে জাহাঙ্গীর আর নেস
ওয়াদিয়া। প্রীতি জিন্টা সংক্রান্ত ঝামেলায় জড়ানো নেসকে আমরা অনেকেই দেখেছি। কিংস
ইলেভেন পাঞ্জাবের অন্যতম মালিক নেস ওয়াদিয়া।
"লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান
" এই আওয়াজ তোলা মহম্মদ আলি জিন্নার সমস্ত উত্তরাধিকারী ভারতবর্ষে।
পাকিস্তানে কেউ নেই... বিভেদ শেষ পর্যন্ত জিততে পারে না।
ফেসবুক থেকে
(মতামত লেখকের একান্ত নিজের এর দায় দায়িত্ব লেখকের)
0 Comments