পারভেজ সেলিম।।
(প্রথম পর্ব)
(প্রথম পর্ব)
ভারতের দিল্লী আজ জ্বলন্ত রক্তাত্ব। সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ৪২ জন নিহত হয়েছে। ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রিয়াজ মনে করছেন,‘দিল্লীর ঘটনা ‘দাঙ্গা’ নয়, এটি রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট গেরুয়া সন্ত্রাসী আক্রমন’। দাঙ্গা হোক কিংবা সন্ত্রাসী আক্রমন তবে এর ভিতরে সেই ধর্মীয় দ্বন্দের পুরোনো ভুত। হিন্দু- মুসলমানের বিবাদে সমর্থন জোগাচ্ছে রাষ্ট্র নিজে। ক্ষমতায় যখন যে এসেছে তারাই তাদের প্রয়োজনে এই দ্বন্দটিকে জিইয়ে রেখেছে। ফলাফল প্রাণ হারিয়েছেন কয়েক লক্ষ মানুষ।
ভারত সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি অসহিষ্ণু আর হিন্দুত্ব মৌলবাদি রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন নরেন্দ দামোদর দাস মোদি। তবে এই সহিংসতা ভারতে কোন ভাবেই প্রথম ঘটনা নয়। কয়েকশ বছর ধরে চলছে এই ধর্মীয় উন্মাদনা। দাঙ্গার ইতিহাস আরো ভয়াবহ ও করুন ।
দেশ ভাগের আগে :
উপমহাদেশে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে নানান কারনে এবং তা সাময়িকভাবে শেষ হয় হত্যাকন্ডের মতো বর্বরোচিত ঘটনার মধ্য দিয়ে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস এ অঞ্চলে কয়েকশ বছরের । দাঙ্গায় এখন পর্যন্ত মারা গেছে ২০ লক্ষের বেশি মানুষ । বাস্তুহারা হয়েছে কোটি মানুষ। এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এখনও চলমান।
উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে প্রথম দাঙ্গা হয় ১৬৭১ সালে। সূত্রপাত সম্রাট আওরঙ্গজেবের জারি করা ধর্ম পালনের নতুন নিময় নীতি। দশ বছর ধরে চলে মুসলমান আর হিন্দুদের এই মারামারি। ধ্বংস হয়ে যায় মসজিদ আর মন্দির। এরপর আরো কিছু দাঙ্গা হয় যার বেশির ভাগ মুসলমান আর পার্সিদের সাথে ।
সবচেয়ে বেশি দাঙ্গা দেখা দেয় ব্রিটিশ ভারতে। ইংরেজরাই তাদের স্বার্থে এই দাঙ্গার মনোবৃত্তি বাঁচিয়ে রেখেছিল মুসলমান আর হিন্দুদের মধ্যে। যা এখনও মানুষের রক্তে সমানভাবে বহমান।
বিট্রিশ ভারতে হিন্দু মুসলমানদের প্রথম দাঙ্গা ১৮৮২ সালে। সালেম দাঙ্গা। মধ্যপ্রদেশের মসজিদ নির্মাণে বাধা দেয়ায় শুরু হয় এই দাঙ্গা। হিন্দুদের দাবি তাদের ধর্মীয় পথের মধ্যে মুসলমানেরা মসজিদ বানিয়েছিল।
সিপাহী বিদ্রোহে হিন্দু মুসলমানের একজোট হওয়ায় নড়ে গিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভিত। বাধ্য হয় কোম্পানীর শাসন শেষ করে রানীর শাসন চালু করতে । ভারত কোম্পানীর হাত থেকে বের হয়ে হয়ে ওঠে ব্রিটিশ-ভারত। আর তখন থেকেই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বৈষ্যম আর বিভেদ সৃষ্টির কৌশল তৈরী করে ইংরেজরা । সেই কালো কৌশলের নাম ‘ডিভাইড এন্ড রুল’, ভাগ করো শাসন করো।
বিশ শতকের প্রথম দিকে এই বৈষম্য আর বিভেদ চরম আকার ধারন করে। শুরু হয় একের পর এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা । ১৯২০-২১ এর মাদ্রাজের ‘ম্যাপপিরা দাঙ্গা' ইংরেজ আর হিন্দু মুসলমানের মধ্যে। পরে ‘কোহাটের দাঙ্গায়’ নিহত হন ১৫৫ জন মানুষের সকলেই হিন্দু অথবা মুসলমান। নাগপুর দাঙ্গায় নিহত হয় ২২ জন । এছাড়া ১৯২০-৩০ সালের মধ্য কয়েক দফায় বিভিন্নখানে কয়েকশ দাঙ্গা হতেই থাকে ।
হিন্দু মসুলমানের সবচেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গাটি হয় কলকাতায়। ১৯৪৬ এর ১৬ আগস্ট শুরু হয় এই হত্যা উৎসব । এক সপ্তাহ ধরে চলে এই দাঙ্গা।‘দীর্ঘ ছুরিকার সপ্তাহ’ বা 'ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে’ 'বা ক্যালকাটা কিলিং' নামে পরিচিত এই দাঙ্গা।৭২ ঘন্টার মধ্যে ৪ হাজার মানুষ নিহত হয়। ১ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছিল ।
ব্রিটিশরা কংগ্রেসের নেতাদের হাতে ভারতীয় ক্ষমতা দিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল। তার প্রতিবাদে সেই ১৬ আগস্ট মুসলিমলীগ হরতাল ডেকেছিল। সেই হরতালের সুত্রধরেই শুরু হয় ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী মানুষ হত্যার উৎসব দাঙ্গা ।
কলকাতার দাঙ্গার প্রতিশোধ নিতেই দুমাসেই মধ্যেই পূর্ববঙ্গের নোয়াখালিতে শুরু হয় আরেক মানুষ হত্যা উৎসব।
১৯৪৬ এর ১০ অক্টোবরের সেই দিনটি ছিল কোজাগরি লক্ষি পূজার দিন। চার সপ্তাহ ধরে চলে এই গণহত্যা। ৫ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয় এই কয়েকদিনে। ধর্ষণ, লুন্ঠন, জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয় । তিন মাস পর নোয়াখালি আসেন অহিংস আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী। তাতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয় তব এর আগে যা হবার তা হয় যায় । কয়েক লাখ হিন্দু বাস্তুচুত্য হয়ে পড়ে । নিহত পাঁচ হাজার মানুষের পরিবার পড়ে এক গভীর অন্ধকারে।
বিহার দাঙ্গা শুরু হয় নোয়াখালির ঘটনার পরপরই। সে বছরই ২৪ আক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর।১৯৪৬ সালে দেশজুড়ে ৩১৭৬ টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। এর আগের বছর শুধু উত্তরপ্রদেশে ১৯৪৫ সালে ১৮০৬ টি দাঙ্গা ঘটেছিল।
১৯৪৬ এর ২৭ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর সবচেয়ে বেশি দাঙ্গা হয়। এর হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বৃটিশ পালামেন্ট দেয়া বিবৃতিতে এত ৫ হাজার নিহত হয়েছিল বলে জানানো হয়। ‘দ্যা স্টেটসম্যান’ পত্রিকা জানায় সেই সংখ্যা সাড়ে ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মতে ২ হাজার আর মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ বলেছিলের ৩০ হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে এই দাঙ্গায়।
দাঙ্গার সূত্রপাত গুলো হয় গুজব বা মিথ্যে তথ্য দিয়ে। ১৯৪৬ এর জুনের ভয়াবহ দাঙ্গার সুত্রপাতটিও হয়েছিল মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে । অভিযোগ ছিল যে মুসলমানেরা এক হিন্দু মহিলাকে ধরে নিয়ে গেছে । পরে জানা যায় পুরোটাই গুজব এবং মিথ্যে। দাঙ্গার ভেজা রক্তের মধ্যেই হিন্দু আর মুসলমানদের জন্য গঠিত হয় আলাদা আলাদা দুটি রাষ্ট্র। হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান। কিন্তু তাতে কি বন্ধ হয়েছিল মানুষ হত্যার এই বিভৎস উৎসব ?
(চলবে ...)
পারভেজ সেলিম
লেখক ও সাংবাদিক
0 Comments