সুজন ভট্টাচার্য ।।
রাম কিষন ডালমিয়া। আজকের ভারতে এই নামটির উল্লেখ প্রায়
শোনাই যায় না। কিন্তু ভারতের অর্থনীতিতে এই মানুষটির অবদান আলোচনা না করলে সরকারি
ক্ষেত্র-র উদ্ভব, বিকাশ ও লয়ের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে
যায়। ডালমিয়া গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাম কিষন ডালমিয়া।
মূলত পূর্ব ভারতকে ভিত্তি করে তিরিশের দশকেই তার উত্থান। সিমেন্ট, চিনি, কাগজ, কয়লাখনি,
ব্যাঙ্ক, বীমা – নানান দিকেই তিনি প্রসার করেছিলেন তার ব্যবসার ক্ষেত্র। আমরা প্রায়শই
টাটা বা বিড়লা গ্রুপের কথা বলি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারতের সবথেকে ধনী ও আর্থিক
প্রতিপত্তিশালী গ্রুপ ছিল ডালমিয়া গ্রুপ। রাম কিষন ডালমিয়ার প্রভাব এতটাই ছিল যে
স্বাধীন দেশে অর্থমন্ত্রী হিসাবে তাঁর নাম-ও প্রস্তাবিত হয়েছিল। এমনকি পাকিস্তান
সৃষ্টির পর মহম্মদ আলি জিন্নাহ তাঁর বম্বের প্রাসাদটি বিক্রি করে দেন রাম কিষনকেই।
১৯৪৬ সাল। ভারতের স্বাধীনতা অনিবার্য। এই সময়ে রাম কিষন
কিনে নিলেন ভারতের প্রখ্যাত মিডিয়া হাউস বেনেট, কোলম্যান অ্যান্ড
কোং যা টাইমস গ্রুপ নামেই পরিচিত। প্রভাবশালী শিল্পপতি পা রাখলেন প্রকাশনার জগতে।
তাঁর পকেটে চলে এল ভারতের সবথেকে পরিচিত প্রকাশনা সংস্থা। সব চলছিল ঠিকঠাক।
ইতিমধ্যে ভারতের প্রথম নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।
ডালমিয়া গ্রুপের পতাকা পতপত করে উড়ছে। ক্রমবর্ধমান ব্যবসা একা সামলানো যাচ্ছে না
বলে রাম কিষন তিনভাগ করলেন নিয়ন্ত্রণ-কাঠামো। মূল ভাগ রাখলেন নিজের হাতে। একাংশের
দায়িত্ব গেল ভাই জয়দয়াল ডালমিয়ার হাতে। অন্য অংশের দায়িতে পেলেন জামাই শাহু শান্তি
প্রসাদ জৈন।
গোল বাঁধালেন প্রধানমন্ত্রীর জামাই। নাম ফিরোজ গান্ধী।
রায়বেরিলির সাংসদ জানতে পারলেন টাইমস গ্রুপ কিনে নেবার পিছনে একটা বড় মাপের আর্থিক
জালিয়াতি আছে। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ফিরোজ গান্ধী পার্লামেন্টে বিষয়টি পেশ
করলেন। টাইমস গ্রুপ কেনার জন্য রাম কিষন নাকি তাঁর মালিকানায় থাকা ভারত ব্যাঙ্ক
এবং ভারত ইনস্যুরেন্স কোং লিমিটেডের অর্থ অবৈধভাবে ব্যবহার করেছেন। শুরু হয়ে গেল
প্রবল হইচই। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রিয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ভিভিয়ান বোসের
নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করলেন। কমিশনের রিপোর্ট স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল ব্যাঙ্ক
ও বীমা কোম্পানির অর্থ অবৈধভাবে ব্যবহার করেছেন রাম কিষন।
দু বছরের কারাদণ্ড হল রাম কিষনের। তিহার জেলে অবশ্য খুব
সামান্য সময়ই ছিলেন তিনি। প্রায় গোটা সময়টাই চিকিৎসার অছিলায় নানান হাসপাতালেই কাটালেন।
সে অবশ্য আমরা আজও তাই-ই দেখি। রাম কিষনের কিসসা এখানেই শেষ ঠিকই। কিন্তু বসে
রইলেন না তাঁর নামে অভিযোগকারী। ফিরোজ গান্ধী পার্লামেন্টেই দাবী তুললেন এমন
আর্থিক জালিয়াতি আটকানোর জন্য বীমা ব্যবসাকে সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
সহমত হল সরকার। ১৯ জুন, ১৯৫৬ পার্লামেন্টে পাশ হল লাইফ
ইনস্যুরেন্স অ্যাক্ট অব ইন্ডিয়া। সেই বছরই যাত্রা শুরু করল লাইফ ইনস্যুরেন্স
কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া, এল আই সি। ভারতে সক্রিয় ২৪৫টি
বেসরকারি বীমা সংস্থাকে অধিগ্রহণ ও একত্রিত করে তুলে দেওয়া হল এল আই সি-র হাতে।
বোঝাই যাচ্ছে, এল আই সি-র জন্মই
হয়েছিল আর্থিক তছরুপ আটকানোর উদ্দেশ্যে। রাম কিষন ডালমিয়ার প্রেতাত্মা আজ বোধহয়
সবথেকে খুশি। তাঁর ভাবাদর্শীরা সেই এল আই সি-র গঙ্গাযাত্রায় উদ্যোগী হয়েছে।
ভাবাদর্শী কারা? স্বাধীনতার কিছুদিন আগেই রাম কিষন গঠন
করেছিলেন অ্যান্টি-কাউ স্লটার লিগ, গো-হত্যা নিবারণের
জন্য। ১৯৪৮ সালে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, যতদিন না গো-হত্যা
আটকানো যাচ্ছে তিনি ভাত-রুটি খাবেন না। ১৯৭৮ সালে মৃত্যু পর্যন্ত সেই শপথ তিনি
রক্ষা করেছিলেন। বোঝা যাচ্ছে?
লেখকের ফেসবুক থেকে
0 Comments