বাউলদের দেহতত্ত্ব ও গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি





কাজি স্বাধীন ।।

ভারত ও বাংলাদেশের গবেষকদের বই থেকে নেয়া বাউল সম্পর্কে কিছু কথা :

এরা কখনো আল্লাহকে স্রষ্টা বলছে তো কখনো নবীকে আল্লাহ বলছে, আবার বলছে গুরুই পরম ব্রহ্মা। নবীকে আল্লাহর ছায়া, কায়া বলছে। এটা অবতারবাদ, স্রষ্টার বিভিন্নরূপ। কারণ বাউলেরা গুরুবাদী। গুরুকে এরা ঈশ্বর বা আল্লাহর অবতার বলে জানে। এরা বিশ্বাস করে যে গুরু অসন্তুষ্ট হলে তার ইহকাল, পরকাল সবই বিনষ্ট হতে পারে। গুরুকে তুষ্ট করাই এদের সাধনার অঙ্গ। [The Bauls of Bangladesh, Anwarul Karim, Lalan Academy, 1980, p. 100]

বাউলদের ধর্ম গড়ে উঠেছে কামাচার এবং মিথুনাত্মক যোগ-সাধনাকে(Erotic love) কেন্দ্র করে। এর চেয়ে ভদ্র ভাষায় এই দেহতত্ত্বকে বোঝানো সম্ভব নয়। তাই (১) দেহ এবং যৌনাচার এদের কাছে ঐশ্বরিক, দেহের বাইরে কিছুই নেই। এখানেই আল্লাহ, নবী, কৃষ্ণ, ব্রহ্মা, পরমাত্মা একাকার, (২) নারী সঙ্গিনী/রতিনিরোধী যৌন মিলন ব্যতীত সাধনা অসম্ভব। এই সঙ্গিনী এক থেকে একাধিক এবং একেকজনের সঙ্গিনী আরেকজনের সাথে মিলন করে সাধনার উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছুবে এটিই উদ্দেশ্য।

স্ত্রী জননাঙ্গই সাধনার লৌকিক স্তরের মৌলবিন্দু। এখানেই মীনরূপে সাঁই(প্রভু/গুরু) বিহার করে। এটিই বাউলদের বারযাখ। তাই বাউল ভক্তি নিবেদন করে এই যোনিপ্রদেশকে। এখানেই তার সিদ্ধি। এই স্তর পার করতে পারলেই সে সাধক। [The Bauls of Bangladesh, p. 416]

তাদের গানের দ্বারা তারা ধর্ম প্রচার করে থাকে। কিন্তু এসমস্ত গানের বিষয় সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারার কারণ হলো সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার। তারা বলে এক, অর্থ আরেক। যেমন স্ত্রীজননাঙ্গকে ঘিরে তাদের এই সাধনকে তারা গানের মধ্যে ত্রিবেণী বলে ডাকে। এই ত্রিবেণীকে বাউল 'আরশীনগর' হিসেবেও অভিহিত করেছে। 'আরশী' অর্থ আয়না। স্ত্রীযোনিতে রতিক্রিয়া বলে যে রসের সৃষ্টি তা পানিরূপ। পানিতে নিজের চেহারা যেমন দেখা যায় তেমনি রস-রতিরূপ পানিদ্বারা পিতামাতার চেহারার আদলে সৃষ্টি হয়। [প্রাগুক্ত, পৃ:৪১৯]

বাউল বিশ্বাস হলো, শুক্র বা বীজরূপী সাঁই মানুষের মধ্যেই থাকে। এটিকে বিন্দুসাধনা বলে। বিভিন্ন সময়ই তাই লামকে সাধনসঙ্গিনী এবং আলিফকে শুক্রাণুর পরিভাষা হিসাবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। দেহকে ঘিরে সব কারসাজি। [প্রাগুক্ত, পৃ:৪২৮-৪২৯]

অধ্যাপক আনোয়ারুল করীম এবং বাংলাপিডিয়ার সূত্রে এ কথা সহজেই জানা যায় যে, প্রাচীন ফিলিস্তিনে বাল নামের এক দেবতার উপাসনা করা হতো। বাল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। তাদের সাধন মাত্রই যৌনাচার। বাউল শব্দটি বাংলায় প্রবেশের এটিও একটি উৎস বলে ধরা হয়। পারস্যে অষ্টম-নবম শতকে এই বাল নামে সূফী সাধনার একটি শাখা গড়ে ওঠে। তারা ছিল সঙ্গীতাশ্রয়ী এবং মৈথুনভিত্তিক গুপ্ত সাধনপন্থী। মরুভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে তারা গান গেয়ে বেড়াত। সেই লোকধর্ম থেকেই এক সময় বাংলায় প্রবর্তিত হয় এই বাউল ধর্ম।

বাউল একটি ধর্ম সম্প্রদায়। বাউলদের ধর্মের তত্ত্ব ও দর্শন আছে, সাধন-পদ্ধতি আছে। এই সময়ের সাধকগণের তত্ত্ব-দর্শন ও সাধনা সংবলিত গানই প্রকৃত বাউল গান [Banglar Baul O Baul Gan, Bhattacharya Upendranath (1951), p. 103]

বাউল অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি।আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। ডক্টর সাহেব আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ’” [ব্রাত্য লোকায়ত লালন (১৯৯৮), সুধীর চক্রবর্তী, পৃ:৪-৯৫]

বাউলদের একমাত্র ধর্মপ্রচারের মাধ্যম গানে তাই তাদের গানে ইচ্ছাপূর্বক ধর্মীয় পরিভাষা ব্যবহার করা হয়ে আসছে। যার অর্থ ভিন্ন হলেও সাধারণ মানুষ যাতে তা ধরতে এবং বিরুদ্ধাচারণ না করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ সবার চেনা লালন ফকিরের দুই চরণ আধ্যাত্মিকতার নমুনা লিখছি - বাড়ির পাশে আরশীনগর, সেথা এক পড়শী বসত করে।

এখানে আরশীনগর স্ত্রীজননাঙ্গের প্রতীক। 'পড়শী' অর্থ বাউলের সাঁই যার অবস্থান স্ত্রীজননাঙ্গে। এই যৌনাচারগুলি বাউল অত্যন্ত চমৎকারভাবে প্রতীকের মাধ্যমে ঢেকে রেখে তাকে শিল্পসুষমামণ্ডিত করে তুলেছে। বাউলেরা সাধারণের মধ্যে তাদের এই (যৌন)সাধনাকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আরবি হরফকে তাদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের প্রতীক হিসাবেও ব্যবহার করেছেন। [The Bauls of Bangladesh, p. 43০]

তাদের গানে গরল মানে রজঃস্রাব। স্রাব শেষে যে রতি নির্গত হয় তাকে ফুল বলে, এর মাঝে সাঁই থাকে। নীর ও ক্ষীর হলো যথাক্রমে নারী ও পুরুষের বীর্য, একটি হালকা, একটি ঘন, দুই মিলে তাদের সাধনার সুধারস। রস বলতে উভয়ের বীর্যকে বুঝায়, মূত্রও বুঝায়। এই রস দিয়ে সৃষ্টি হয়, তাই রসের জ্ঞান সাধনায়(মিলন) সিদ্ধি ঘটে। অমাবস্যা বলতে নারীর ঋতুবতী কালকে বুঝানো হয়েছে, এটি তাদের মহাযোগের সময়, এসময় সাঁই অবতীর্ণ হয়। আবার সকল সংখ্যার মাঝে সংকেত লুকানো। যেমন: তিন মানে ত্রিবেণী, চার- মল, মূত্র, রজঃ, শুক্র, পাঁচ- চুম্বন, মর্দন, শোষণ, মর্দন, সম্মোহন ইত্যাদি। [বাংলার বাউল ও বাউল গান, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (১৯৫১), পৃ:৩৬৯-৪৩৭]

দেহতত্ত্বের সাংকেতিক শব্দে গাঁথা তাদের তথাকথিক আধ্যাত্মিকতা। বাউল ধর্মে তাদের নিষ্কাম নারীভোগ এবং সঙ্গমসাধনার মাঝে সিদ্ধিলাভের বিবরণকে সরাসরি প্রকাশ নিষেধ। তাই তারা আধ্যাত্মিকতার ধর্মীয় চাদর ধার করে নিয়েছে। এই ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস শিয়াদের মাঝেও পরিলক্ষিত হয়। তাদের তাকিয়্যা এবং কিতমান অনুযায়ী নিজের মতবাদ প্রকাশ করা নিষেধ; বরং যা বিশ্বাস করে ঠিক তার বিপরীতটা প্রকাশ করবে প্রয়োজনে। সেই ইরানের শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলের সূফী বাল সম্প্রদায় থেকে বাংলার বাউলরাও এই নীতি গ্রহণ করেছে সম্ভবত। লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের প্রথম বাউল বিষয়ে পিএইচডিধারী ডঃ আনোয়ারুল করীম তার ৭২৬ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপির শেষে বলেছেন,

বাউলসাধনা অত্যন্ত গুপ্ত এবং কেবল দীক্ষিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দীর্ঘ ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে বিভিন্ন বাউল-ফকিরদের সঙ্গে চলে-ফিরে আমি যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছি, তার সংক্ষিপ্তসার এখানে উল্লেখ করলাম। বাউলদের ধর্মানুসারে এসব তথ্য প্রকাশ মহাপাপ সমতুল্য। তথাপি গবেষণার স্বার্থে আমি এসব তথ্য প্রকাশে সাহসী হয়েছি। [বাংলাদেশের বাউল, পৃ:৬৭৫]

কাজেই বিভিন্ন গানে মোকাম, মঞ্জিল, আল্লাহ, রাসূল, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহাম্মদ-খাদিজাসহ বিভিন্ন আরবি পরিভাষা, আরবি হরফ শুনলেই তাদের বিরাট পীর, মুর্শিদ, নীরিহ আধ্যাত্মিক জগতের মুসলমান ভাবার কোনো কারণ নেই। এগুলোর আমাদের জন্য ধোঁকার উপকরণ। যেমন:

আলিফ হয় আল্লাহ হাদী
মিমে নূর মুহম্মদী
লামের মানে কেউ করলে না
নুক্তা বুঝি হল চুরি।

নূরের মানে হয় কুরআনে,
নূরবস্তু সে নিরাকার প্রমাণে,
কেমন করে নূর চুঁয়ায়ে হায় সংসারে

এটি দেখে লালনকে মুসলিম সাধক, সূফী উপাধি দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এটিই তাদের লক্ষ্য ছিল। তাহলে ব্যাখ্যাটা জেনে নেওয়া যাক - বাউল সাধনায় নুক্তা অর্থ বীর্য লালন নুক্তাকে নূররূপেও চিহ্নিত করেছে। নুক্তার সাধারণ অর্থ বিন্দু। এই বিন্দুর স্বরূপ সঠিকভাবে নিরূপণ করাই বাউল সাধনার লক্ষ্য। এই বিন্দুই পুরুষের বীর্য। এই বীর্যকে বাউল নূর বলে উল্লেখ করেছে। এই নূর চুঁইয়েই জগৎসংসার। [The Bauls of Bangladesh, p. 429]
এছাড়া ঈশ্বরের অবস্থানের ব্যাপারে তারা সর্বেশ্বরবাদী। ঈশ্বর জগতে এবং জগৎ ঈশ্বরে অবস্থিত বটে এবং সমস্ত জগৎ ঈশ্বরও বটে [বাংলার বাউল, ৪৯২-৪৯৩, ৪৮২, ৪৮৯]

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডঃ আনোয়ারুল কবীর সূফী বাউল এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের উপর গবেষণা শেষ করে মন্তব্য করেন, সূফীরা সংসারত্যাগী। প্রসঙ্গত বলা যায়, ইসলামের অধ্যাত্মসাধনার দুইটি ধারা। এক, সাময়িক নিভৃতচারিতা; যেমন হযরত মুহাম্মাদ(সা) আল্লাহর নৈকট্য এবং সত্যসাধনায় গিরিগুহায় সাময়িক সময়কালে নিভৃত জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং যেভাবে হযরত মূসা(আ) ৪০ দিন সংসার থেকে দূরে স্রষ্টার ধ্যানে মগ্ন থেকেছেন। এই নিভৃতচারিতা সারাজীবনের জন্য নয়। সংসার সত্যাদর্শে গড়ে তোলার জন্য সাময়িক সংসার ত্যাগ ছিল এক অর্থে শক্তি বা প্রেরণার উৎস। ইসলামের এই অধ্যাত্মসাধনা সংসারবিমুখতায় স্থিতি লাভের জন্য নয়। দুই, ইসলামের এই অধ্যাত্মসাধনা কর্মবাদের উপর গড়ে উঠেছে। অপরদিকে, পারস্যের সূফীবাদ বৈরাগ্য জন্ম দিয়েছে যা ইসলামের পরিপন্থী। আল্লাহ সর্বপ্রকার সন্ন্যাস এবং খানকা নির্মাণ নিষিদ্ধ করেছেন। [The Bauls of Bangladesh, pp. 81-82]


যে সকল দলিল পেশ করা হয়েছে তারা সবাই বাংলাদেশ এবং কোলকাতার নামযশা বাউল গবেষকদের কথা। কাউকে ছোট কিংবা বিদ্রুপের কোনো উদ্দেশ্যে নয়  অজ্ঞতা জনিত ভুল সংশোধনীয়।


লেখকের ফেসবুক হতে
(মতামত একান্ত লেখকের)

Post a Comment

0 Comments