দাঙ্গা : মানুষে মানুষে রক্তের উন্মাদনা ! পর্ব :০২




পারভেজ সেলিম ।।

(আগের পর্বের পর...)


৪৭ দেশ ভাগের পর :


দেশভাগের পরও হিন্দু-মুসলমানের মন থেকে দাঙ্গার বিষ সরে যায়নিদু সম্প্রদায়ের দুটি আলাদা দেশ হবার পরও ঘৃণা আর বিদ্বেষ কমেনি একটুকুভারতে নির্যাতিত হতে থাকে মুসলমান আর দুই পাকিস্তানে খুন হতে থাকে হিন্দু ।

বরিশাল ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ জুড়ে চলে হত্যাকান্ড ১৩ ফেব্রুয়ারি গুজব ছড়ানো হয় কলকাতায়  শেরে বাংলা ফজলুল হককে খুন করা হয়েছে এরপরই পূর্ববঙ্গে আজকের বাংলাদেশে শুরু হয় হিন্দু নিধন । গবেষক শুভশ্রী ঘোষের মতে ২৫০০ হিন্দুকে সেই সময় হত্যা করা হয়েছিল  এবং তথ্যচিত্র নির্মাত সুপ্রিয় সেন এর মতে সে সময় সাড়ে ৬ লাখ হিন্দু ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল

১৯৫০ সালের ৪ এপ্রিলে বিধানচন্দ্র রায় ঘোষণা করেন ২০ লক্ষ শরনার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেরবীন্দ্র ত্রিবেদির মতে এ সংখ্যা ৩৫ লক্ষ এবং গবেষক এ রায়ের মতে নিহত সংখ্যা ৫ লাখ  এবং শরনার্থীর সংখ্যা ৪৫ লাখ ।
ভারতের হয়রত বাল দরগা শরীফে সংরক্ষিত মুহাম্মদ( সা.) এর  চুল চুরি হয়ে গেছে এমন গুজব শুনেই পূর্ববঙ্গে শুরু হয়  দাঙ্গা সাল ১৯৬৪ এই ঘটনায় যত মানুষ বাস্তুচুত্য হয়  দেশ ভাগের পর একসাথে এত মানুষ দেশ ত্যাগ করেনি বাংলাদেশের হিন্দুরা সব কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়

১৯৬৭ সালের ২২-২৯ আগস্ট  রাচি-হাতিয়ার দাঙ্গায় নিহত হয় ১৮৪ জন দুবছর যেতে না যেতেই গুজরাতে প্রথম হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা হয় ১৯৬৯ সালে।  নিহত হয় ৫১২ জন মানুষ

বাংলাদেশ জন্মের পর :

এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে  বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ এনয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ বাংলাদেশি মানুষ হত্য করে পাকিস্তানীরা যার মধ্যে বেশীরভাগই ছিল হিন্দুপ্রায় ১ কোটি মানুষ আশ্রয় নেয় ভারতের বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্পে
একটি দেশ থেকে তিনটি আলাদা রাষ্ট্র তৈরি হবার পরও থামেনা মানুষে মানুষে এই হত্যা উৎসব । ১৯৮৪ মহারাষ্ট্রের বিহন্দির দাঙ্গায় ২৭৮জন নিহত হয়পরের বছর গুজরাতে আবার সংঘর্ষ শুরু হয় এবার মারা যায় ২৭৫ জন ধ্বংস হয় মসজিদ আর মন্দির ।

বাবরী মসজিদ  ধ্বংস করা হয়েছে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে ১৯৯২ এর অক্টোবরের শেষের দিকে শুরু হয় বিভৎস  দাঙ্গা ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর চলে এর চরম ভয়বহতা । ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চলে এই দাঙ্গা বাবরি মসজিদ নিয়ে শুরু দাঙ্গায় নিহত হয় ৯০০ বেশি মানুষবাংলাদেশে এখনও এর রেশ থামেনি ১৯৪৬-৪৭, ১৯৫০, ১৯৬৪ ও ১৯৭১ এই চার দফার পর আবার দেশত্যাগের এক ভয়াবহ স্রোত শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গের দিকে।

এরপর আসে গুজরাটের দাঙ্গা। সেইসময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ভারতের আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী । ছিলেন। অভিযোগ তার নির্দেশেই শুরু হয়েছিল এই দাঙ্গা । ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় ২ হাজারের বেশি মুসলমান হত্যা করা হয়

 সেই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি সাবরমতি এক্সপ্রেসে আগুনে প্রাণ যায় ৫৯ জন হিন্দ্র ট্রেন যাত্রীর, কারো মতে এই সংখ্য ২৫৯ জন। এর জন্য কোন প্রমাণ ছাড়াই দায়ী করা হয় মুসলমানদেরহিন্দুরা গুজরাতে মুসলমান নিধন শুরু করে । অভিযোগ নরেন্দ্র মোদির নির্দেশে  পরিকল্পিত ভাবে এই আগুন লাগানো হয় এর জের ধরে মুসলমান নিধন করবে বলে এক মুসলমান গর্ভবতী নারীর পেট কেটে ৯ মাসের ভ্রণকে বের করে আগুনে পুড়িয় মারা হয়েছিল এই দাঙ্গায় ৫৬৩ টা মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছিল । ২.৫ লাখ মুসলমান গৃহহীন হয়ে পড়েছিল পরবর্তীতে নানাবতি তদন্ত কমিশন নরেন্দ্র মোদিকে বেকসুর খালাস দিয়ে দেয় ।

ভারতে দাঙ্গার ভূত এখনও বিরাজমান২০১৩ তে মোজাফ্ফর নগর দাঙ্গা হয় ৬২ জন নিহত হয়এরপর বিভিন্ন সময় দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা দেখা যায় । সবশেষ এনআরসি ও সিএ বিরোধী  আন্দোলন হিন্দু-মুসলমানের বিভেদে রুপ নিচ্ছেদিল্লীর ঘটনায় ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মারা গেছে ৪২ জন মৃত্যের সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কেউ জানে না ।

 তবে এখন বাংলাদেশ বেশ শান্ত। দাঙ্গার খবর এখন খুব একটা পাওয়া যায় নাএর দুটি কারন হতে পারে। হয় দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা কমেছে অথবা সংখ্যালঘুরা প্রতিরোধ করার শেষ শক্তিটুকুও এখন  হারিয়ে ফেলেছে দ্বিতীয়টি বেশি সমর্থনযোগ্য কারন দেশে এখনো সংখ্যালঘু হিন্দু কিংবা বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের খবর পাওয়া যায় প্রায়ই শোন যায় সংখ্যালঘুদের ধর্ষণ, খুন এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনার খবর। দেশের অসুস্থততা প্রমাণের জন্য একটিমাত্র ঘটনাই যথেষ্ঠ নয় কি ?

১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশে হিন্দু ছিল ২২ শতাংশ। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তা ১৪ শতাংশে নেমে আসে আর ২০১১ সালের জরিপ বলছে দেশে হিন্দু রয়েছে এখন মাত্র ৮.৫ শতাংশমাত্র ৭২ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠি তিনভাগের একভাগে নেমে এসেছে এ্‌ই দেশ কি তবে শুধু মুসলমানদের ?

যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতার রাক্ষসকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে  সেই স্বাধীন দেশে এর চাইতে হতাশার খরব আর কি হতে পারে !! ভারত হোক আর বাংলাদেশ, ধর্মের নামে মানুষ হত্যার জঘন্য উৎসব যতদিন বন্ধ হবে না ততদিন মানুষ হিসেবে কোন অর্জনে আপনার মাথা উঁচু হবে না।



পারভেজ সেলিম
লেখক ও সাংবাদিক

Post a Comment

0 Comments