কে বলেছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হাস্যরস করা যাবে না?



তসলিমা নাসরিন ।।


ইউটিউবে গাঁজা খেয়ে বেসুরো গান গায় গালিবাজ রোদ্দুর রায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারও ভক্ত তৈরি হয়। একটি চাঁদ উঠেছিল গগনের ভিডিওতে তো প্রায় ষাট লাখ লাইক পড়েছে। এর নাম বাস্তবতা। এর নাম আমাদের সময়, যে রকমই এই সময় হোক, এ আমাদের সময়। সকলে তো রবীন্দ্র সঙ্গীত বিকৃত করছে না। রোদ্দুর রায় জাতীয় লোকেরা করছে। এও এক ধরণের বাক স্বাধীনতা। 

তার যা খুশি সে তা বলছে, যেভাবে গান গাইতে ইচ্ছে করে, সেভাবে গাইছে। তার কিছু ভক্ত যদি শরীরে তার আওড়ানো ফাজলামো এঁকে ঘোরাফেরা করে, তাতে কার কী? এইসব বাঁড়া, শালা, বাঞ্চোত শব্দগুলোকে রোদ্দুর রায় অশ্লীল বলে মনে করে না। সে মনে করে দারিদ্র অশ্লীল, প্রতারণা অশ্লীল, ঘৃণা অশ্লীল,হত্যাকান্ড অশ্লীল, যুদ্ধ অশ্লীল। সে মনে করে মানুষের তৈরি শব্দ অশ্লীল নয়। শব্দ কারো ক্ষতি করে না। 

যে ভদ্রলোকেরা এই শব্দগুলোকে অশ্লীল বলছে তাদের অনেকে মনে মনে এইসব শব্দ বহুবার উচ্চারণ করে, অথবা এই শব্দগুলো তারা ঘরে বলে, বাইরে বলে না, অথবা বাইরে বলে কিন্তু লেখে না, প্রদর্শন করে না । বাইরে একটা নকল সমাজ, নকল সাজ, নকল হাসিই দেখতে চায়। ১০০ বছর আগে যেমন ভাবে মানুষ চলতো, যেমন ভাবে বলতো, তেমন ভাবে আজও চলুক বলুক চায়। কিন্তু সমাজ তো বদলে যাচ্ছে, আগের মতো কেন সবকিছু থাকবে। বদল কিন্তু সবসময় ভালোর দিকে যায় না, খারাপের দিকেও যায়। বদলটা মনের মতো না হলে কান্নাকাটি করার তো দরকার নেই। বুঝতে হবে এই সমাজ এই মানসিকতা হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি। একেই আমরা সকলে মিলে একটু একটু করে তৈরি করেছি।

কলকাতার শাসকেরা তো বাংলা অন্ত প্রাণ নিরীহ নিরপরাধ তসলিমাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে, ওই তাড়ানোর চেয়ে কি বাঁড়া শব্দটি বেশী অশ্লীল? আসলে মানুষ এখনও অশ্লীলতা খোঁজে শব্দে, কর্মে নয়। রবীন্দ্রনাথের যুগে ছোটরা বড়দের চোখে তাকিয়ে কথা বলতো না, এখন ছোটরা বাপকেও বলে দেয়, ফাক, হোয়াট বুলশিট আর ইউ টকিং ম্যান! এসবকে যদি আমরা আধুনিকতা বলি, স্মার্টনেস বলি, তবে মেয়েদের পিঠে হাস্যরসের জন্য লেখা বাঁড়া চাঁদ উঠেছে গগনে দেখলে আমরা আঁতকে উঠি কেন? কে বলেছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হাস্যরস করা যাবে না? ভগবানকে নিয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাবে না কেন?

বাংগালিরা আমেরিকার সমাজে বাস করার জন্য আকুল। আমেরিকায় কি শুধু ডিগ্রি আর ডলারই ভেসে বেড়াচ্ছে, গালি ভাসছে না? নতুন প্রজন্ম ফাক ছাড়া ক'টা বাক্য বলে শুনি! আমরা ছেলেমেয়েদের আমেরিকার স্বপ্ন দেখাবো, আমেরিকার ফিল্ম দেখাবো, হিপ হপ শোনাবো, কিন্তু বাংলা সংস্কৃতিকে ভাল না বাসলে, বাংলা গানকে বিকৃত করলে, বা আমেরিকানদের মতো গালিগালাজ করলে কপাল থাপড়াবো , তা কেন? চোখের জল মুছে ফেলে তার চেয়ে সন্তান সন্ততিদের এই শিক্ষা দিন যেন মিথ্যে না বলে, যেন প্রতারণা না করে, যেন নির্যাতন না করে, যেন লোভী না হয়, যেন স্বার্থান্ধ না হয়। জগত হয়তো এর চেয়ে বেশি কিছু চায়ও না।

লেখকের ফেসবুক হতে

Post a Comment

0 Comments